শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাস-ট্রাকের কাঠামো পরিবর্তন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

অধিক সুবিধা নিতেই অসাধু মালিকরা যানবাহনের আকার পরিবর্তন করে মিনিবাসের ৩০ আসনের পরিবর্তে ৪০-৪২ আসন করছেন
ম আব্দুলস্নাহ রায়হান
  ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৫

সারাদেশে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস ও ট্রাক। বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস ও ট্রাক অবৈধভাবে কাঠামো পরিবর্তন করে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে কোনো পরিবহণের মূল আকৃতি বা কাঠামো পরিবর্তন মোটরযান আইন পরিপন্থি। সড়ক ও পরিবহণ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা জানান, কাঠামো পরিবর্তনকারী যানবাহন সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যানবাহন। তারপরও এসব যানবাহনকে মূল আকৃতিতে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত বিভিন্ন ফি ও যাত্রী ভাড়ায় সুবিধা নিতেই বাস-ট্রাক ও মিনিবাসের মালিকরা এসব করছেন। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই এসব কাঠামো পরিবর্তন করে সড়কে বাস-ট্রাক চালানো হচ্ছে। চেসিস পরিবর্তন করার বিষয়টি সরাসরি তদারকির এখতিয়ার বিআরটিএর। কিছু কর্মকর্তার লোভের কারণেই এমনটা করার সুযোগ পাচ্ছেন মালিকরা। বাসের চেসিস পরিবর্তন করা বড় ধরনের অপরাধ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং এ ধরনের যানের সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার ২৩০টি। এর সব কটির সামনে-পেছনে লাগানো হয় অতিরিক্ত কাঠামো (বাম্পার)। আবার বডির দুই পাশে লাগানো হয় তিন কোনা বড় আকৃতির লোহার পাতের অ্যাঙ্গেল ও লোহার হুঁক। একই সঙ্গে অতিরিক্ত মাল বোঝাই করার জন্য ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সামনে ও পেছনে মিলিয়ে মূল কাঠামোর (বডি) চেয়ে ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা করা হয়। আর চওড়ায় ২ ফুটের বেশি বাড়ানো হয়। বিশেষ করে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের চালকের কেবিনের চেয়ে মালামাল বহনের অংশ চওড়া করে ফেলা হয়। এরকম কাঠামো পরিবর্তন করে তিনগুণ পর্যন্ত বেশি মালামাল বহন করা হচ্ছে। দেশে বাস-মিনিবাস আছে প্রায় ৬৮ হাজার। কিছু কিছু বাস-মিনিবাস লম্বা করে আসন বাড়ানো হয়েছে। বাম্পার লাগানো হয়েছে সব মিনিবাসে। এ ছাড়া ভেতরে মিনিবাসের ৩০ আসনের পরিবর্তে ৪০ থেকে ৪২ আসন করে বাসে রূপ দেওয়া হচ্ছে। মোটরযান আইন অনুসারে, যানবাহনের মূল কাঠামো বা আকৃতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন অবৈধ। পরিবর্তিত কাঠামো নিয়ে কোনো যানবাহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বিআরটিএ দীর্ঘদিন এসব যানের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দিয়ে আসছে। গত কয়েক বছরে সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় সামনে আসে বাস ট্রাকের কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়টি। এরপর বাস-ট্রাক মূল কাঠামোয় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর ধর্মঘট আর চাপের কারণে কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করেও পিছিয়ে আসে সরকার। ফলে যানবাহনের আকার পরিবর্তনের বিষয়টি বহুদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। আর এ কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হারও বাড়ছে। বিআরটিএ'র তথ্যানুসারে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজার ৪৫০টি। এসব দুর্ঘটনায় ১৮ হাজার ৫১০ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ৪৪২ জন। ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৬৮ দশমিক ৪১ শতাংশের পেছনে বাস ও ট্রাক জড়িত। দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ১ শতাংশেরই উৎস বাস। আর ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্ঘটনায় যুক্ত ট্রাক। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশই মুখোমুখি সংঘর্ষ কিংবা পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার কারণে ঘটছে। আর একমাত্র কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে কাঠামোগত (আকৃতি) পরিবর্তন। বিআরটিএ সূত্র জানায়, সারাদেশে চলাচলকারী বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনের বেশির ভাগেরই চেসিস আমদানি করা হয়। আমদানীকৃত চেসিস এনে বডি সংযোজন করা হয় লোকাল মোটরযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। উৎপাদনকারী কোম্পানির ম্যানুয়ালে প্রতিটি যানের দৈর্ঘ্য, উচ্চতা ও চওড়া নির্ধারণ করা থাকে। ম্যানুয়ালে বলা থাকে, যানবাহনের বডি চাকার মাপের চেয়ে বেশি বাইরে যেতে পারবে না। আর চালকের কেবিন ও মালামাল বহনের বডি একই মাপের হবে। সূত্র জানায়, আমদানি করা ট্রাকগুলো লম্বায় ১৬ ও ২০ ফুট এবং টেইলর ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কিন্তু মালিকরা এসব ট্রাক লম্বায় ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত এবং চওড়া ২ ফুট পর্যন্ত বাড়িয়ে থাকেন। বাসের ক্ষেত্রেও লম্বায় বাড়ানো হয়ে থাকে। আর এসবই হচ্ছে নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। এর সভাপতি হিসেবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিলে অন্য মন্ত্রণালয়, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরাও সদস্য হিসেবে থাকেন। প্রতি বছরই বাস-ট্রাকের আকৃতি পরিবর্তনের বিষয়টি কাউন্সিলের বৈঠকে সরকারের নজরে আনা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৮তম বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক দেশে যানবাহনে অবৈধভাবে আকৃতি পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরেন। এ সময় তিনি জানান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক নিম্ন আয়ের দেশেও এ ব্যবস্থা নেই। কাঠামো পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য শুরু হলে বাংলাদেশের ট্রাক ভারতসহ অন্য কোনো দেশে প্রবেশ করতে পারবে না। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, সাইনবোর্ডের কয়েকটি গ্যারেজ ঘুরে দেখা যায়, ইঞ্জিন ও চেসিস বাইরে থেকে আনা। এরপর বডি তৈরির সময় চেসিসের আকার পরিবর্তন করে বাসের আসন সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীতে হারুন অটো মোবাইলের মালিক ও মিস্ত্রি হারুন অর রশীদ জানান, মালিকরা যেমন করে করতে বলেন তারা সেভাবেই বডি তৈরি করেন। এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। তিনি জানান, যে চেসিসে ৩৬ বা ৩৭ সিটের গাড়ি হয়, মালিকরা সেখানে ৪২ সিটের গাড়ি বানাচ্ছেন। ট্রাকের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত বড় বডি তৈরি করিয়ে নেন মালিকরা। তার মতে, নতুন অবস্থায় এসব যানবাহনে সমস্যা দেখা না দিলেও কিছুদিন পর ব্যালেন্সিং সমস্যা হয়। ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জানান, আইনে যানবাহনের চেসিস পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। চেসিস পরিবর্তন করে যেসব গাড়ি চলছে তাদের ধরার দায়িত্ব বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাছাড়া গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কিংবা ফিটনেস দেওয়ার সময়ই তো বিআরটিএ এসব গাড়ি আটকে দিতে পারে! বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, কাঠামো পরিবর্তনকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এসব যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নতুন করে যানবাহনের নিবন্ধন দেওয়ার সময় কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। অতীতে কিছু ভুল হয়েছে। এখন থেকে এ বিষয়ে খুব কঠোর বিআরটিএ। নিবন্ধন ও ফিটনেসের বাইরে বিআরটিএ নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এসব যানবাহনকে জরিমানা ও ডাম্পিং করছে। এ বিষয়ে পুলিশকেও আরেকটু তৎপর হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে