করোনা অতিমারির কারণে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষা দীর্ঘ বিলম্বের পর সম্প্রতি শেষ হয়েছে। তবে পরীক্ষা দেরিতে অনুষ্ঠিত হলেও ফলাফল খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। আর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে মাত্র তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের ওপর পরীক্ষা হওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, কোচিং ছাড়া ভার্সিটি-মেডিকেলে চান্স হয় না- এ ধারণা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে-প্রাণে অনেক আগে থেকেই গেঁথে আছে। এর ওপর করোনা সংকটে এবার এইচএসসি পরীক্ষা স্বাভাবিক নিয়মে না হওয়ায় এ বিশ্বাস আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এই সুযোগে কোচিং সেন্টারগুলোও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায়ের ফাঁদ পেতেছে। এদিকে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, ভর্তি কোচিংয়ে শুধু টাকা হাতিয়ে নেওয়াই নয়, এতে ভয়াবহভাবে শিক্ষা বৈষম্যও তৈরি হচ্ছে। সরকার স্কুল-কলেজে কোচিং নিষিদ্ধ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেলে ভর্তির জন্য কোচিং বন্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ বিষয়টি একরকম বৈধতা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীন উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভার্সিটি ও মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুদের প্রায় ৯২ শতাংশ কোচিং করছে। অথচ এদের এক তৃতীয়াংশেরও কম এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। রাজধানীর ফার্মগেট, মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এলাকাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো বিপুল সংখ্যক কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠেছে। উদ্ভাস, ইউসিসি, আইকন, পজিট্রন, সাইফুর'স, ফোকাস, রেটিনা ও প্রাইমেটসহ পুরনো কোচিং সেন্টারের পাশাপাশি নতুন কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে ক্লাস করিয়ে ভার্সিটি ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল প্রাপ্তির প্রতিশ্রম্নতি দেওয়া হচ্ছে। তবে এ কোচিং সেন্টারে বিগত সময় কোচিং করানো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি কোচিং সেন্টার দিনে ২০-২৫টি ব্যাচ পড়ায়। আর প্রতি ব্যাচে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ক্লাসভিত্তিক টাকার বিনিময়ে ক্লাস নেন। ঢাকার বাইরে কলেজের শিক্ষার্থীরাও অনেক কোচিং সেন্টারে ক্লাস করান। প্রায় প্রতিটি কোচিং সেন্টারেই গতানুগতিক পদ্ধতিতে পড়াশোনা করানো হয়। এতে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি পরিবর্তন করলে এসব প্রতিষ্ঠানে কোচিং করা শিক্ষার্থীদের ১০ শতাংশও চান্স পাবে না বলে মনে করেন তারা। প্রসঙ্গত, কোচিং ব্যবসা ও প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে মেধাক্রম অনুযায়ী মেডিকেলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সংকট দেখা দেয়। ঝামেলা এড়াতে সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়। অভিযোগ আছে কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন থেকে সরে আসতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ইন্ধন দিয়েছিল। যদিও কোচিং সেন্টারের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, প্রতিযোগিতার যুগে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে তারা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন। তবে শিক্ষাবিদরা মনে করেন, অর্থনৈতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি কোচিং একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। শহরের শিক্ষার্থীরা সহজে খ্যাতনামা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করতে পারছে। অথচ গ্রামের শিক্ষার্থীদের শহরে এসে কোচিংয়ে ভর্তি এবং বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা বাবদ লাখ টাকার ওপরে খরচ হচ্ছে। যা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। এ অবস্থায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ানোরও চেষ্টা করেন না। এ প্রসঙ্গে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, কোচিং ছাড়া চান্স পাবে- এতে অভিভাবকদের আস্থা নেই। উচ্চ ব্যয়ের কারণে সাধারণ ঘরের ছেলে-মেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট কিংবা মেডিকেলে পড়তে পারে না। কোচিংয়ের জন্য বৈষম্য তৈরি হয়। কোচিং বন্ধে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ধারণা পরিবর্তন করা জরুরি। এছাড়া পাবলিক পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করে ভর্তি পদ্ধতি পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুর ইসলাম মনে করেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ও মান সমান হলে সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমান আকর্ষণ থাকবে। এতে কোচিং বাণিজ্য কমে আসবে। পাশাপাশি তিনি ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি মেধা মূল্যায়নের কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। এজন্য সৃজনশীল পদ্ধতিতে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি বাবদ বেশিরভাগ কোচিং সেন্টার গড়ে ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। বুয়েট ও মেডিকেলের কোচিংয়ে ভর্তি ফি নেওয়া হচ্ছে ২৪ থেকে ২৮ হাজার টাকা। অথচ মাত্র দু'বছর আগেও এ ফি ছিল প্রায় অর্ধেক। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দু'টি কোচিং করে। এতে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার জন্য মাসিক খরচ ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। ফলে প্রতি শিক্ষার্থীকে ভর্তি প্রস্তুতিতে ব্যয় করতে হয় লক্ষাধিক টাকা। বগুড়া থেকে আসা শিক্ষার্থী কামরুল আলম জানান, তিনি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শান্তিনগর উদ্ভাস কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। ঢাকায় তার কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় মুগদায় বাসা ভাড়া করেছেন। কোচিং ফি এবং ঢাকায় থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত বাবদ তার তিন মাসে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। তার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এ বিশাল অর্থ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। তবে জীবনের স্বপ্ন পূরণে তার বাবা-মা পৈতৃক ভিটা বন্ধক রেখে এ অর্থ জোগাড় করার উদ্যোগ নিয়েছে। কামরুল জানান, তার মতো নিম্নআয়ের আরও অনেক পরিবার এ ঝুঁকি নিয়েছে। তার ভাষ্য, গ্রামাঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে এ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। এতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের জীবনের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাবে।