বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
সেনাবাহিনী নামাবে ডিএনসিসি প্রকল্প নিয়েছে ডিএসসিসি

খাল উদ্ধার কার্যক্রম মুখে মুখেই!

লাইজুল ইসলাম
  ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৮
খাল উদ্ধার কার্যক্রম মুখে মুখেই!
খাল উদ্ধার কার্যক্রম মুখে মুখেই!

রাজধানীর খাল উদ্ধারে কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। উদ্ধারের প্রথমদিকে টনকে টন আবর্জনা, বাসাবাড়ির খাট, সোফা ইত্যাদি উত্তোলন করে তারা। এরপর আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। এমনকি খাল উদ্ধারেও তাদের কোনো তৎপরতা নেই। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সব খাল উদ্ধার হবে। সেনাবাহিনীর সাহায্যও নেওয়া হবে। কিন্তু এখনো মুখে মুখেই রয়ে গেছে খাল উদ্ধার কার্যক্রম। চলতি বছরের শুরুতে খাল উদ্ধারে মাঠে নামবে সেনাসদস্যরা- উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এমন ঘোষণা দিলেও তা হয়নি। এখনো কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। কবে থেকে শুরু হবে তা উত্তর সিটির কোনো কর্মকর্তা জানেন না। যদিও এ বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। রাজধানীর অধিকাংশ খালই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায়। এই খালগুলো অধিকাংশ দখল আর দূষণে মৃতপ্রায়। সব খাল অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হবে হুঙ্কার দিলেও গত এক বছরে শুধু ময়লা উত্তোলন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ খাল বুঝে নিলেও সীমানা নির্ধারণ ও খালের জায়গা উদ্ধারে তেমন কোনো কাজ শুরু করেনি দুই সিটি করপোরেশন। শুধু ময়লা উত্তোলনেই আটকে আছে তারা। গত এক বছর ধরে বিভিন্ন খাল পরিদর্শনে গিয়েছেন দুই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা। তারা যাওয়ার আগে দুই সিটির লোকজন ও স্থানীয় কাউন্সিলর সব পরিষ্কার করে রাখেন। তারা চলে গেলে আবার আগের মতোই ময়লার ভাঁগাড়ে পরিণত হয় খালগুলো। সরেজমিন যাত্রাবাড়ীর পূর্ব দোলাইর পাড় গিয়ে দেখা যায়, খালের ওপর ময়লার ভাঁগাড়। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি খাল। যে খালে এক সময় মাছ পাওয়া যেত, স্থানীয়রা গোসল করতেন। নৌকা চলত। বর্তমানে খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। খালের পাশে তৈরি হয়েছে সড়ক। বাড়ি-ঘর দোকানপাট কি নেই খালের জমির ওপর। পরিচয় গোপন করে স্থানীয় এক চা দোকানি বলেন, 'প্রতিদিন ম্যানেজ করতে হয়। টাকা দিয়ে এই দোকান চালাই। ভাড়াও দিতে হয়। তবে কাকে টাকা দেই তা বলা যাইব না। আর আপনে এত কথা জাই না কি করবেন। গত বছরের প্রথম দিকে পরিষ্কার করা হয়েছিল খাল। কিন্তু আবার আগের মতো হইয়া গেছে। মেয়র আসার কথা শুনলে আবার সব ঠিক হইয়া যাইব। এ ছাড়া পুরা খালই তো দখল হইছে। বাকি আছে মাত্র এটুকু।' দীর্ঘদিনেও এসব খাল উদ্ধার না হওয়ায় হতাশ স্থানীয়রা। এমন পরিস্থিতিতে যাত্রাবাড়ী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা রিংকু চৌধুরী বলেন, 'আমাদের এই ধোলাই খালে ৪০ বছর আগেও \হমাছ পাওয়া যেত। আমরা গোসল করতাম বন্ধুরা মিলে। সেই দিন আর নেই। যারা এই খাল দখল করেছেন তাদের নাম বলতেও ভয় লাগে। সবাই এলাকার ক্ষমতাশালী লোক।' তিনি আরও বলেন, 'দুই পাশে বড় বড় রাস্তার করার কথা কে বলছে? স্থানীয়রা রাস্তা চাইছে, কিন্তু খাল ভরাট হোক এটা চায় নাই। এই রাস্তা করে খাল ভরাট করছে সরকার। বলা হয় স্থানীয়দের চলাচলের জন্য রাস্তা। কিন্তু আমরা কি বলছি খাল ভরাট করে রাস্তা বানান। খাল দখল এখানে শিখাইছেই সরকার। তারপর না মানুষ দখল করছে। তারপরও যতটুকু আছে তা তো ঠিক রাখবে। সেটাও তো করে না।' এদিকে খিদির খালের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদ করতে শুরু করে উত্তর সিটি করপোরেশন। ২০২১ সালের মার্চে অভিযান চালায় তারা। বেশকিছু স্থাপনা উচ্ছেদও করে কর্মীরা। কিন্তু দীর্ঘ আট কিলোমিটারের বেশি খালটি পুরোপুরি উদ্ধারে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। সরেজমিন দেখা যায়, খালের ভেতর থেকে ময়লা উত্তোলনের পরও আবার ময়লার ভাঁগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর শাহাজাদপুরে আরেকটি খাল যেটি বর্তমানে ডিএনসিসি খাল নামে পরিচিত। আগে এটি ওয়াসার খাল নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু রাজধানীর ম্যাপ বের করলে দেখা যায় এটি শাহাজাদপুর খাল নামেই উলেস্নখ আছে। এই খালটিও দুই পাশে দখল হয়েছে। রাস্তাও নির্মাণ করা হয়েছে দুই পাশে। খাল দখলের সঙ্গে জড়িত স্থানীয়রাই। তবে কেউ কথা বলতে রাজি না। রাজধানীতে মোট খাল আছে ২৬টি। এই খালগুলো আগে দেখভাল করতে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এগুলো উদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দিয়ে দেওয়া হয় দুই সিটি করপোরেশনকে। ওয়াসা খাল রক্ষণাবেক্ষণে অপারগতা জানানোর কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া ইউনিয়নগুলোয় আরও ১৩টি খাল রয়েছে। যা দুই সিটিকে দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। এই খালগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ দুই সিটি করপোরেশনের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। সূত্র বলছে, গত তিন দশকে রাজধানীর বিভিন্ন খাল দখল হওয়ার কারণে জলবদ্ধতা চরমে পৌঁছেছে। রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় না। এই অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী। তাই রাজধানীর খালগুলোকে উদ্ধার করে বৃষ্টির পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে রাজধানীতে আর জলযট না হয়। ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন এই খাল রক্ষণাবেক্ষণ ও উদ্ধারে কাজ করেছেন। তাদের একজন বলেন, এখন খাল উদ্ধারে সবার আগে চিন্তা করতে হবে কোন জরিপ অনুযায়ী খাল উদ্ধার করতে চায় সিটি করপোরেশন। তিনটি জরিপের একটি ধরে খাল উদ্ধারে এগুতে হবে। আর শুধু ময়লা অপসারণ করে খালের নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। যতটুকু ছিল পুরোটাই উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এবার খালের দায়িত্বে তাই উদ্ধার কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হবে বলেও মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা। খাল উদ্ধার নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগরপরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'খাল উদ্ধারে সিএস ও আরএস জরিপ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সিটি জরিপকে এই কাজের মধ্যে আনা যাবে না। খালের দুই পাশে ওয়াকওয়ে করতে হবে। যাতে হাতির ঝিলের মতো দুই পাশে মানুষ হাঁটতে পারে। যেখানে অতিরিক্ত জায়গা থাকবে সেখানে খেলার মাঠ করে দিতে হবে। একটি স্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।' তিনি বলেন, পলিমাটি অপসারণ করে খালগুলোয় পানি আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যা গত এক বছরে হয়েছে তা আরও স্থায়ীভাবে করতে হবে। তাহলে আর রাজধানীতে জলযট হবে না। আর যেসব স্থানে খালের জমি দখল হয়েছে তা উদ্ধার করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দোলাইর পাড় খাল যেসব স্থান দখল আছে সেগুলো উদ্ধার করে আমরা পানি প্রবাহ নিশ্চিত করব। সেই অনুযায়ী কাজ চলছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের বলেন, জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর ও হাজারীবাগ খাল উন্নয়নে দুটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। সেখান থেকে পাস হয়ে এলেই কাজ শুরু হবে। খালের দুই পাশে মানুষ হাঁটবে, খেলার জায়গা থাকবে। আর বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল উদ্ধারে কনসালট্যান্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশি কনসালট্যান্ট দিয়েই বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধারে কর্মপরিকল্পনা করা হবে। তিনি বলেন, 'এতদিন মেয়র স্যারের মৌখিক নির্দেশনায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করেছি। প্রথমে আমরা চিহ্নিত করেছি কোথায় কোথায় জলবদ্ধতা হয়। সেসব স্থানে পাইপলাইন স্থাপন করেছি। যেসব স্থানে পাইপলাইন, বক্স কালভার্টে ময়লা আটকে ছিল সেগুলো পরিষ্কার করেছি। রাজধানীর শান্তিনগর, রাজারবাগ, সচিবালয়, নিউমার্কেটসহ বেশকিছু এলাকায় এবার আর জলাবদ্ধতা হবে না।' উত্তর সিটি করপোরেশন তাদের হাতে থাকা খালগুলো নিয়ে কি করবে সেই বিষয়ে জানতে প্রধান প্রকৌশলীকে কয়েকবার ফোন করার পরও তিনি ধরেননি। উত্তর সিটির মেয়রের ফোনেও ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। তাই খাল উদ্ধার ও পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে কিছুই জানা যায়নি। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে এক অনুষ্ঠানে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, 'জানুয়ারি মাসেই মাঠে নামবে সেনাবাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা ভূমি জরিপ দেখে খাল উদ্ধার করে দেবে। তবে নতুন কোনো জরিপ দেখে খাল উদ্ধার করা হবে না। সিএস ও আরএস মাপ দেখে খাল উদ্ধার করা হবে। নকশায় যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই খাল নির্ধারণ করা হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে