শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাইকারদের দৌরাত্ম্যে নাকাল নগরবাসী

বেপরোয়া গতিতে রাস্তায় মোটর সাইকেল চালিয়ে গোটা নগরীতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে উঠতি বয়সি বখাটে তরুণরা। এমনকি ফুটপাতে উঠেও তীব্রগতিতে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে তারা
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৪ মে ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ মে ২০২২, ০৯:২৫

ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে ১০টা। মালিবাগ বিশ্বরোড ধরে মৌচাক রেলক্রসিংয়ের দিক থেকে বিকট আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের সামনের রাস্তায় সেই প্রবল আওয়াজ যখন পৌঁছল, তখন পথচারী, যানবাহন চালক-যাত্রী ও আশপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের কানে তালা লাগার অবস্থা। দেখা গেল, একসঙ্গে চারটি মোটর সাইকেলে চেপে আসছে কয়েকজন যুবক। কারও মাথাতেই হেলমেট নেই। কোনো মোটরবাইকে চালকসহ আরোহী তিনজন। বেপরোয়া গতির প্রত্যেকটি মোটর বাইকেরই সাইলেন্সার খোলা! খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের মোড়েই কর্তব্যরত দুই ট্রাফিক পুলিশ। বিকট আওয়াজ তুলে যাওয়া ওই মোটরবাইকের চালকরা তাদের সামনে দিয়ে গেলে আটকালেন না তারা। বরং কিছুটা প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। সাইলেন্সারবিহীন এ ধরনের মোটরবাইক দেখেও আটকালেন না কেন? প্রশ্নকর্তার নাম-ধাম-পরিচয় জেনে ট্রাফিক পুলিশ বললেন, 'সব সময় সবাইকে ধরা যায় না! অনেক ব্যাপার থাকে! কী এমন ব্যাপার? উত্তর পাওয়া গেল না ওই আইন-রক্ষকদের কাছ থেকে। শুধু বিকট শব্দই করেই নয়, বেপরোয়া গতিতে রাস্তায় মোটর সাইকেল চালিয়ে গোটা নগরীতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে উঠতি বয়সী বখাটে তরুণরা। এমনকি যখন তখন তারা ফুটপাতে উঠেও বিকট শব্দ তুলে তীব্রগতিতে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। এতে অহরহই ছোট-বড় নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় কেউবা গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গতির ধাক্কায় পথচারী ও রিকশা আরোহীর প্রাণহানির ঘটনাও একেবারে কম নয়। আবার এসব দুর্ঘটনায় বাইকারদের অঙ্গহানি ও মৃতু্যর ঘটনাও সম্প্রতি অনেকটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যানজটের শহর ঢাকায় দ্রম্নত চলাচলের উপযোগী এ বাহনটি নগরবাসীর কাছে 'আতঙ্ক' হয়ে উঠেছে। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা মহানগরীতে বাইকারদের দৌরাত্ম্য বেশি হলেও চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনাসহ অন্য নগরীতে তা কম নয়। প্রতিটি নগরীতেই মোটর সাইকেলে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও ভয়াবহভাবে বেড়েছে। লাইলেন্সবিহীন মোটর সাইকেলের শব্দ তান্ডব ও বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে ছোট-বড় দুর্ঘটনা সংঘটনের ঘটনায় প্রতিটি নগরীতেই প্রতিদিন অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ছে। এদিকে আইনগতভাবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ট্রাফিক পুলিশের কঠোর নজরদারি না থাকায় বখাটে যুবক-তরুণ অনেক বাইকার তাদের মোটর সাইকেলে চোখ ধাঁধানো বিকন লাইট, তীব্র মিউজিকাল হর্ন ও সাইরেন লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কেউ আবার সময়-সুযোগের্ যাব-পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইর ঘটনা ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা জানান, বখাটেরা যাতে দ্রম্নতগতিতে ফুটপাত মোটর সাইকেল চালিয়ে পথচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে এজন্য তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বাসাবাড়ির সামনের ফুটপাতে স্বল্প দূরত্বে লোহার খুঁটি পুঁতে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তাতেও অনেক সময় শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কেননা কোনো কোনো বাইকার নানা কসরত করে এসব খুঁটির ফাঁক গলে ঠিকই মোটর সাইকেল নিয়ে ফুটপাতে উঠে পড়ছে। পথচারীরা এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করলে তারা বাজে মন্তব্য করছে কিংবা মারমুখী হয়ে উঠছে। নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, এসব বিষয়ে তারা থানা পুলিশ, ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম, দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট ও জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে ফোন দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। বরং এসব ব্যাপারে অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হয়েছে। এমনকি অনেকে নানাভাবে হয়রানিরও শিকার হয়েছেন। বিকট শব্দে মোটর সাইকেল চালানো বাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এমন বিকট আওয়াজ করে তারা বাইক চালাচ্ছেন। আর এজন্য মোটর সাইকেলের সাইলেন্সার খুলে ফেলা ছাড়াও অন্য পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, কেউ সাইলেন্সার পাইপের ভিতরে থাকা জালটি ফাটিয়ে দেন। কেউ আবার ২-৩ হাজার টাকা খরচ করে 'ফ্রি ফ্লো' সাইলেন্সার কিনে বাইকে লাগান। অথচ এ ধরনে সাইলেন্সার যুক্ত বাইক ব্যবহার করা হয় ট্র্যাক রেসিংয়ে। কারণ ওই 'ফ্রি ফ্লো' সাইলেন্সার লাগানো থাকলে মোটরবাইকের ওজন ৮-১০ কেজি কমে যায়। তাতে রেসিংয়ের সময়ে গতি তুলতে সুবিধা হয়। তবে ঢাকার ব্যস্ত সড়কে রেসিং করার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে মোটরবাইকের কান ফাটানো আওয়াজ ও বেপরোয়া গতিতে সাধারণ মানুষের যে প্রাণান্তকর অবস্থা হচ্ছে, তা ঠেকাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সে উত্তর জানতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অসহায়ত্বের কথা শোনা গেছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, বিকট শব্দে ও বেপরোয়া গতিতে মোটর সাইকেল চালানো বখাটে বাইকারদের একটি বড় অংশ প্রভাবশালীদের সন্তান কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো তাদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে তারা ঢালাওভাবে এসব বখাটেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকছে। তবে বুঝে-শুনে দু'চারজন বখাটে বাইকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে মুগদা বিশ্বরোড এলাকায় দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট জানান, বখাটে মোটরবাইকাররা ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। তারা বিকট শব্দের সাইলেন্সবিহীন, বিকন লাইন ও সাইরেনযুক্ত মোটরসাইকেল নিয়ে সাধারণত হাইওয়ে কিংবা প্রধান সড়কে খুব কম ওঠেন। এদের বেশিরভাগই পাড়া-মহলস্নার অলিগলিতে এসব মোটর সাইকেল চালান। এ ছাড়া গভীররাতে যখন ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় ডিউটিতে থাকেন না তখন তারা প্রধান সড়ক দাপিয়ে বেড়ান। দিনে জরুরি প্রয়োজনে তারা মেইন রাস্তায় উঠলেও খুব ধীরগতিতে মোটর সাইকেল চালান। এ কারণে সাইলেন্সের বিকট আওয়াজ টের পাওয়া যায় না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে স্থানীয় থানা পুলিশকে তৎপর হওয়া জরুরি বলে দাবি করেন ওই ট্রাফিক কর্মকর্তা। তবে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বললে তারা কৌশলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ভাষ্য, মোটর সাইকেলে নিষিদ্ধ হর্ন, সাইরেন, বিকন লাইট কিংবা অন্য কোনো যন্ত্রাংশ লাগানো হলে তাদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বেপরোয়া গতির যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও ট্রাফিক পুলিশের আছে বলে দাবি করেন তারা। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শব্দ তান্ডব সৃষ্টি করে বেপরোয়া গতিতে চালানো বেশিরভাগ মোটর সাইকেলের নিবন্ধন নেই। এসব বাইকের চালকদেরও একটি বড় অংশ অদক্ষ হলেও মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে নিয়েছে। বিআরটিএ'র মুখপাত্র, পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সঠিক নিয়ম মেনেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু লাইসেন্স নেওয়ার পর চালকরা অনেকে নিয়ম মানেন না। এ ছাড়া অনেকেই লাইসেন্স না নিয়ে মোটর সাইকেলে চালাচ্ছেন। এ কারণে এ যানে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণ চলাচল সীমিত থাকলেও ২০২০ সালে সারাদেশে গ্রাহকরা ৩ লাখ ১১ হাজার ১৬টি মোটর সাইকেল নিবন্ধন নিয়েছেন। ২০২১ সালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২টি মোটর সাইকেলের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সারাদেশে নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৮৮। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাই রয়েছে ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮১৭টি মোটর সাইকেল চলাচল করছে। এ ছাড়া বর্তমানে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪১৫টি মোটর সাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে। যার ২৫ শতাংশই ঢাকায়। এদিকে পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ঢাকায় চলাচলকারী মোটর সাইকেলের সংখ্যা বর্তমানে ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দেশের অন্যান্য জেলায় নিবন্ধিত বিপুল সংখ্যক মোটর সাইকেল ঢাকা মহানগরীতে চলাচল করছে। এ ছাড়া অনিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যাও লক্ষাধিক বলে মনে করেন তারা। যার একটি বড় অংশ বখাটে যুবক ও তরুণরা চালাচ্ছে। যে কারণে নগরীতে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ভয়ংকরভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, মহাসড়কে কিভাবে চলতে হয় তরুণ ও কিশোররা অনেকেই তা ভালোভাবে জানে না। উন্নত দেশগুলো মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ঠিক উল্টো। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত গতিসম্পন্ন মোটর সাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তা না হলে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা কমবে না বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, যে যেভাবে পারছে বাইক চালাচ্ছে। আর বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সারাবিশ্বে গণপরিবহণ উন্নতি করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র উল্টো। তাই সহজে যাতায়াতের জন্য মানুষ বেশি বেশি মোটর সাইকেল ক্রয় করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোটর সাইকেল সংস্কৃতি রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালচ্ছে। তাই দুর্ঘটনার সংখ্যা ও এর দৌরাত্ম্য বাড়ছে। মোটর সাইকেল নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহণকে উন্নত করলে এ সংকট কাটানো যেত বলে মনে করেন তিনি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এই দুর্ঘটনাগুলোয় মৃতু্যর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়েছে। যা চলতি বছরে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে