বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র

এ বছর আষাঢ়-শ্রাবণেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। ৪২ বছরের মধ্যে দেশে ৫৭ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, জীবন ও প্রকৃতিতে
আলতাব হোসেন
  ১৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল দেশের মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে দেশে। অথচ এ বছর আষাঢ়-শ্রাবণেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। ৪২ বছরের মধ্যে দেশে ৫৭ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, জীবন ও প্রকৃতিতে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালে কালবৈশাখীর মৌসুমে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০২০ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারা দেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরুতে স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙে শীতে তাপমাত্রা নেমে আসে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তারপর শরৎকালে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। ২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওড়ের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে যায়। ২০১৭ সালের ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ মাসেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। বাংলা চৈত্র মাসে আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি হয়। এতে আগাম বন্যায় আঘাত হানে শস্যভান্ডার খ্যাত দেশের হাওড়াঞ্চলে। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে একেক বছর একেক ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত পাঁচ বছরের আবহাওয়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়ছে। অসময়ে একই সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

গঙ্গা অববাহিকায় প্রায় বছরই রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ চলতি বছর বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সারা দেশে কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে যৎসামান্য বৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছর দেশে ৪২ বছরের মধ্যে দেশে ৫৭ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি আবার হঠাৎ উধাও হওয়ার ঘটনার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যে, প্রতিবছর এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ওই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে। ১৯৫০ সাল থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক দ্য লোভেনের তথ্য অনুসারে, ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যায় ২২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায়।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা-মাছ গিয়ে ডিম পাড়ে। এ সময় পাট জাগ দিতেও প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে স্বাভাবিকের চেয়েও গড়ে প্রায় ২৫ ভাগ কম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতিবছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা ও খুলনা-বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ শতাংশ বাড়ছে। অতিবৃষ্টির কারণে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে ফসল উৎপাদন বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। হেমন্তের বৃষ্টি অস্বাভাবিক এবং কৃষির জন্য ক্ষতিকর। দেশের কৃষকরা বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছেন, এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের শুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নামে। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের প্রস্তুতিও থাকে ওই সময়কে ধরে। অথচ এ বছর বৃষ্টির পানির অভাবে আমন রোপন পিছিয়ে গেছে। পানির অভাবে পাট জাত দিতে পারেননি কৃষক, এতে নিম্নমানের পাট উৎপাদন হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে