শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত জনতা

শ্রদ্ধায় সিক্ত বাংলার দামাল ছেলেরা
যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
রোববার বিকালে বঙ্গভবনে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে কেক কাটেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও তাদের সহধর্মিণীরা -ফোকাস বাংলা

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত জনতা শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্বরণ করছে স্বাধীনতার মহানায়কদের। জাতি ফুলেল শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে বাঙালি জাতির অহংকার আর গৌরবে গাথা স্বাধীনতা দিবসের দিনটি। এদিন শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদি। যেন সব ফুল ফুটেছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের শ্রদ্ধায় সিক্ত করতে।

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভু্যদয়ের ৫২তম বার্ষিকীতে জাতির বীর সন্তানদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে দিনের প্রথম প্রহরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। শহীদ বেদিতে প্রথমে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির পরপরই জাতির সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেখানে এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায় এবং বিউগলে বেজে উঠে করুণ সুর।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। সেখানে তিনি লেখেন, 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শ্রদ্ধা জানাই মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের। হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত মা-বোনদের প্রতি জানাই আমার শ্রদ্ধা।'

বইতে প্রধানমন্ত্রী আরও লেখেন, 'বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছি আমার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা এবং আমার তিন ভাই ভ্রাতৃবধূসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে যারা শাহাদতবরণ করেছেন তাদের।'

শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে লেখেন, 'আজকের এই দিনে আমি প্রত্যয় করি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব। ইনশাআলস্নাহ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।'

এর আগে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হয় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। রোববার ভোর ৫টা ৫৪ মিনিট থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩১ বার তোপধ্বনি প্রদর্শন করা হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ঢাকা পুরাতন বিমান বন্দর এলাকায় (তেজগাঁও) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩০ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ৬টি গান ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বীর শহীদদের প্রতি গান স্যালুট প্রদর্শন করে।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ডক্টর হাছান মাহমুদ, মাহবুলউল আলম হানিফ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

এরপর শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। কেন্দ্রীয় চৌদ্দ দলের পক্ষ থেকে মাহবুবউল-আলম হানিফের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর ফুল দেন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সংসদের হুইপ।

এরপর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আইজিপি চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালও শ্রদ্ধা জানান স্মৃতিসৌধে।

সাভার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা বিএনপির

সকালে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর মূল বেদির সামনে কিছুক্ষণ নীবর দাঁড়িয়ে নেতারা মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

সেখানে সাংবাদিকদের বিএনপি মহাসচিব বলেন, ৫১ বছর আগে জাতীয়তাবাদী দলের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল।

ঢাকা জেলা, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিএনপি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধ

শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সন্তানরা। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধা জানানো শেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার নিয়ে দলে দলে জনস্রোত প্রবেশ করে স্মৃতিসৌধে।

শ্রদ্ধা জানাতে আসা মাহফুজ নামে এক ব্যক্তি বলেন, 'আমরা রাতেই শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদনের অপেক্ষায় ছিলাম। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আমরা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রবেশ করেছি। ৩০ মিনিটের মধ্যেই শ্রদ্ধার ফুলে ভরে যায় বেদি। এ যেন শহীদদের প্রতি জাতির আজন্ম ভালোবাসা। বেদি ভরা শ্রদ্ধার ফুল দেখে হৃদয় যেন ভরে গেল। এ যেন জাতির চিরকৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।'

সূর্যসন্তানদের টানে দেশের উত্তরের জেলা রংপুর থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসেছেন শফিকুল নামে যুবক। তিনি বলেন, 'জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়াও দেশের সব স্থানে নানা আয়োজনে এই দিবস পালন করা হয়। আমি এত কাছ থেকে বীর শহীদদের কখনো শ্রদ্ধা জানাতে পারিনি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দূর থেকে শ্রদ্ধা জানানো আমার কাছে কমতি মনে হচ্ছিল। তাই সরাসরি জাতীয় স্মৃতিসৌধে চলে এসেছি। আজকের দিনটি আমার জীবনের স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।'

জামালপুর থেকে পুরো পরিবার নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাফিজুল করিম বলেন, 'আমরা যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ স্বাধীনভাবে চলছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কিছু দেওয়ার নেই। এই শ্রদ্ধা জানাতেও যদি আমরা কার্পণ্য করি তাহলে তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে জানবে। তাই শুরু থেকেই স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে ধারণা দিতে আমার তিন বছরের সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করে প্রাণটা শীতল হয়ে গেছে। রমজান মাসে লাখো মানুষ রোজা রেখেও শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। এটা আমাদের গর্ব। আমরা তো যুদ্ধ করতে পারিনি, কিন্তু যুদ্ধে জীবন দেওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে রাখতে পেরেছি।'

গার্মেন্টসকর্মী নূসরাত বলেন, 'আমরা সারা দিন কারখানায় কাজে থাকি। আজ শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই কয়েকজন সহকর্মী মিলে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। এসে দেখি ফুলে ভরা শহীদ বেদি। এত অল্প সময়ে শ্রদ্ধার ফুলে বেদি ভরে গেছে। আরও প্রায় লাখো মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছেন। আজ ফুলই ফুটেছে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বীর এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'আমি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। আমাদের যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা সর্বোচ্চ। আজ আমার শহীদ ভাইদের যেভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে তা দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। আমি বেঁচে আছি তাই উপলব্ধি করতে পারছি। যারা জীবন দিয়েছেন তাদের হয়ে আমি জাতির কাছে যেন সর্বোচ্চটা পেয়েছি। এই শ্রদ্ধা, এই মর্যাদায় আমি আবেগে আপস্নুত। আমি চাই শহীদদের আজকের দিনের মতো যেন প্রতিদিন জাতি স্মরণ করে। আমরা স্বাধীনতা উপহার দিয়েছি। এই স্বাধীনতা রক্ষা করা জাতি তথা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সব শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আমার এটাই চাওয়া।'

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বজ্রবাণীর পর বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে ঢাকাকে মৃতু্যপুরী বানিয়ে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা ইপিআরসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ হলেও পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের সামনে তা টিকেনি বেশিক্ষণ। মেশিনগান, কামানের গোলার পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় শহরজুড়ে।

পৈশাচিক বর্বরতার মধ্যেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে পাকিস্তানি বাহিনী। তার আগেই বাংলাদেশকে 'স্বাধীন' ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে তারবার্তা পাঠিয়ে যান তিনি, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয় ইপিআরের ওয়্যারলেস বার্তায়।

মরণপণ লড়াই চলে পরের নয়টি মাস। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ধরা দেয় বিজয়। বাঙালির আত্মত্যাগ পরিণতি পায় বিশ্ব মানচিত্রে 'বাংলাদেশ' নামে এক নতুন রাষ্ট্রের অবয়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে