বান্দরবানের রুমা উপজেলার মুয়ালপি পাড়ায় ফের স্থানীয় দুই সশস্ত্র সংগঠন ইউপিএফ গণতান্ত্রিক ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের মধ্যে দিনভর গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার ভোর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুর্গম মুয়ালপি পাড়ায় ভোরে গোলাগুলি শুরু হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে আশপাশের পাড়ার লোকজন যাতায়াত বন্ধ করে দেন। রাত ৯টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, 'সকাল থেকে ইউপিএফ গণতান্ত্রিক ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে। এ ঘটনায় এখনো কোনো হতাহতের খবর পাইনি।'
স্থানীয়রা জানান, মোয়ালপি পাড়া থেকে আতঙ্কের মধ্যে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি ছেড়ে আসার পাঁচ দিনের মাথায় আবারও গোলাগুলির ঘটনা ঘটল। মঙ্গলবারের গোলাগুলির ঘটনার পর এখন বম সম্প্রদায়ের মানুষও পাড়া ছেড়ে গেছে।
রুমা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মনির হোসেন মঙ্গলবার বিকালে বলেন, 'ভোর ৪টা থেকে মুয়ালপি পাড়ায় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ও কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে বলে জানতে পেরেছি। থেমে থেমে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত গোলাগুলি হয়েছে। এরপর আর গোলাগুলি শোনা যায়নি। মনে হয়, আপাতত বন্ধ আছে।
স্থানীয়রা সংবাদমাধ্যম কর্মীদের জানান, রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোয়ালপি পাড়ায় মূলত মারমা ও বম সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। এখানে ৫০টির মতো মারমা পরিবার এবং ৮০টির মতো বম পরিবার বসবাস করে। উপজেলা সদর থেকে এলাকাটি প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে।
গত ২০ এপ্রিল ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে এই পাড়া থেকে ৪৯টি মারমা পরিবার বাড়ি থেকে এসে রুমা উপজেলা সদরে মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আশ্রয় নেয়। তখন পাড়াবাসী জানিয়েছিলেন, তাদের পাড়া থেকে দুইজনকে কেএনএফ (যা স্থানীয়দের কাছে 'বম পার্টি' নামে পরিচিত) ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতন করে। পরে পাড়াবাসীর অনুরোধে ছেড়ে দেওয়া হলেও ১৮ এপ্রিল আবার ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে স্থানীয়রা ১৯ এপ্রিল রুমা বাজারে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করলে তারা প্রাণনাশের হুমকি পায়। তাদের ঘরে ঘরে ঢুকে দরজায় আঘাত করা হয়। এতে ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়।
পাইন্দু ইউপি চেয়ারম্যান উহ্লা মং মারমা বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, 'আমিও গোলাগুলির ঘটনা শুনেছি। তবে সেখানে তো অনেকেই আছে। কাদের কাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, সেটা জানি না। পাহাড় বাসিন্দাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছি। হয়ত তারা পাড়া থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে, আমি তাও জানি না।
পাইন্দু ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য অং সা প্রম্ন মারমা বলেন, 'গোলাগুলির ঘটনার আগেই পাড়া থেকে মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন চলে গিয়েছিলেন। এখন বম সম্প্রদায়ের লোকজনও চলে গেছেন। পাড়া খালি হয়ে গেছে, কেউই নেই। বম সম্প্রদায়েরর লোকজন কোথায় গেছে, এখনো জানতে পারিনি।'
জানা যায়, ৭ এপ্রিল রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মাঝামাঝি পাইন্দু ইউনিয়নের খামতাং পাড়ায় ইউপিএফ গণতান্ত্রিক ও কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের গোলাগুলির পর আটজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় খামতাং পাড়া, মুয়ালপি পাড়া, পাইক্ষ্যং পাড়া, ক্যপস্নং পাড়া থেকে আটশর বেশি মারমা, বম, খিয়াং সম্প্রদায়ের মানুষ পাড়া ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। তারা এসে রুমা ও রোয়াংছড়ি সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেন। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও উঠেন।
পাড়াবাসী বাড়ি ছেড়ে আসার পর তাদের অনেকের বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বাড়িঘর ভেঙে মালামাল লুট করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন খিয়াংরা। ঈদের আগ থেকে অনেকেই পুলিশ ও প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে আতঙ্ক ও শঙ্কা মাথায় নিয়েই পাড়ায় ফিরতে শুরু করেন। এর মধ্যে আবার গোলাগুলির ঘটনা পাড়াবাসীর মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কেএনএফ, স্থানীয়ভাবে 'বম পার্টি' নামে পরিচিত এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন 'জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া'র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ওর্ যাব। কখনো কখনো তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।
এর জের ধরে জানুয়ারির শেষে রুমার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহিন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে শহরে চলে আসেন। সে সময় পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার সবকিছু ফেলে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হলরুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেয়। চার-পাঁচ দিন পর তারা আবার পাড়ায় ফিরে যায়।
মার্চের শুরুর দিকে অভিযানের মধ্যে 'আতঙ্কে' রুমা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০-৪০০ মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সে সময় বন্ধ হয়ে যায়।