সরকার আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার পর এক সপ্তাহ পার হতে চললেও আগের মতো চড়া দামেই তা বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে এক-দেড় টাকা কমলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। মজুতদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ভোক্তা অধিদপ্তর কোল্ড স্টোরেজগুলোতে অভিযান চালালেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। বরং সেখান থেকে প্রকাশ্যে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে তারা পাল্টা সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আলু আমদানির হুমকি দেওয়া হলেও মজুতদার সিন্ডিকেট তাতে থোড়াই কেয়ার করছেন।
মজুতদাররা কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বিক্রি না করায় বাজারে উল্টো সংকট দেখা দিয়েছে। বাধ্য হয়ে পাইকাররা বেশি দামেই তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে ভোক্তার ঘাড়ে বাড়তি দামের খড়গ আগের মতোই রয়ে গেছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশ্যে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বিক্রি না হলেও এক মজুতদারের সঙ্গে আরেক মজুতদারের 'সিস্নপ' (আলুর মালিকানার দলিল) বেচাকেনা জমে উঠেছে। এছাড়া পাইকারদের কাছেও একই কৌশলে কোল্ড স্টোরেজের আলু বিক্রি হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষি বিপণন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭০০ টন। কোল্ড স্টোরেজে এখনো মজুত আছে ২৪ লাখ ৯২ হাজার টন। যা মজুতদার সিন্ডিকেট স্বাভাবিক মুনাফায় বিক্রি করতে চান না। তারা কেজিপ্রতি নূ্যনতম ৮ টাকা অতিরিক্ত মুনাফায় এ আলু বিক্রি করে বাড়তি ১ হাজার ৯শ' ৯৩ কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নিতে চান। আর এ টার্গেট নিয়ে তারা নানা ফন্দি আঁটতে শুরু করেছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ মিশন নিয়ে জেলাভিত্তিক আলুর মজুতদার সিন্ডিকেট দফায় দফায় গোপন বৈঠক করছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে তারা আলু বিক্রি না করায় ভোক্তা অধিদপ্তর ২৭ টাকা কেজি দরে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু পাইকারদের কাছে বেচে দেওয়ার যে হুমকি দিয়েছে তা মোকাবিলায় কাকে, কীভাবে ম্যানেজ করে করা যায় তার পথ খুঁজছে। এছাড়া সরকার আলু আমদানির অনুমতি দিলে তা তাদের দুই হাজার কোটি টাকা হাতানোর মিশনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটিও পর্যালোচনা করছে।
গোয়েন্দারা জানান, আলু আমদানির হুমকির বিষয়টিতে মজুতদার সিন্ডিকেট ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেননা মজুতদাররা ধরেই নিয়েছেন, আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এরপর এলসি খুলে আমদানিকারকরা আলু আনার তৎপরতা শুরু করবে। এতে টার্গেটকৃত আলু আনতে সবমিলিয়ে তিন থেকে চার সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি সময় লাগবে। মজুতদার সিন্ডিকেট এক থেকে দেড় সপ্তাহ আলু বাজারে না ছাড়লে দেশে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। ফলে সরকার বাধ্য হয়েই তাদের কাছে হার মানবে।
তবে মজুতদাররা অনেকেই তাদের এ ফন্দি আঁটার কথা অস্বীকার করেছেন। মুন্সীগঞ্জের একাধিক মজুতদার জানান, সরকার যেভাবে হিসাব করে আলুর দাম নির্ধারণ করেছে, তা সঠিক হয়নি। এতে নানা অসঙ্গতি রয়ে গেছে। এবার মৌসুমেই তাদের আলু কিছুটা চড়া দরে কিনতে হয়েছে। কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখার আগে-পরে বেশকিছু আলু পচে যায়, এতে তাদের লাভের একটি অংশ গচ্চা যায়। এছাড়া উৎপাদন ও মজুত সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা যে তথ্য দিয়েছে তা গোলমেলে। যে কারণে সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি দামে আলু বিক্রি করলে তাদের কেনা দাম উঠবে। তবে কোল্ড স্টোরেজে রাখার খরচ তাদের পকেট থেকে গচ্চা যাবে বলে দাবি করেন মজুতদাররা। আলুর দাম আরও কিছুটা বাড়িয়ে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা করা হলে তারা খুশি মনে বাজারে আলু ছাড়বে। তা না হলে পরিস্থিতি জটিল হবে বলেও শঙ্কার কথা জানান।
যদিও আলুর মজুতদারের এসব যুক্তি খুব বেশি যুক্তিযুক্ত নয় বলে দাবি করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তবে আলুর উৎপাদন ও মজুত নিয়ে বেশখানিকটা গোলমেলে তথ্যের কথা স্বীকার করেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ বছর দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে এ বছর ১ কোটি ১১ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাব বলছে, আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন।
এদিকে দেশে আলুর চাহিদার হিসাবের ক্ষেত্রেও ফারাক রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। আবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে আলুর চাহিদা ৮৯ লাখ টন। আর হিমাগার মালিক সমিতি মনে করে, দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক হিসাব না থাকায় একাধিক সিন্ডিকেট এ সুযোগ নিচ্ছে। বাজারে মাছ-মাংস ও সবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষ আলু খাওয়া কিছুটা বাড়িয়েছে। কিন্তু এতেও আলুর দাম এতটা তেঁতে ওঠার কথা নয়।
এদিকে গত কয়েকদিন পাকা রশিদের মাধ্যমে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বিক্রি না হলেও বিভিন্ন কৌশলে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ আলু বের করে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দারা ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনে এ তথ্য দিয়েছে।
জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে কোল্ড স্টোরেজের মজুতদাররা নিজেদের মধ্যে সিস্নপ বেচাকেনা করছেন। আবার কেউ কেউ বাইরের পাইকার ও আড়তদারদের কাছে বস্নাঙ্ক প্রাইজে (ফাঁকা দাম) আলু বিক্রি করছে। এ প্রক্রিয়ায় আলুর নূ্যনতম দাম ধরে দেওয়া হলেও সর্বোচ্চ দাম উলেস্নখ করা হয় না। বাজার অনুযায়ী পাইকার ও আড়তদাররা আলু বিক্রি করে নূ্যনতম দামের ওপরের লাভের অংশ ভাগাভাগি করে নেন। তবে মজুতদারের বেঁধে দেওয়া নূ্যনতম দামের চেয়ে কম দামে আলু বিক্রি করা হলে তিনি সে দায় নেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হিমাগারগুলোতে বেঁধে দেওয়া ২৬-২৭ টাকা দামে আলু বিক্রি হলে সব খরচ বাদ দেওয়ার পর প্রতি কেজিতে মজুতদারদের মুনাফা হবে ৬ থেকে ৮ টাকা। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকায় আলু বিক্রি হলে পাইকারি পর্যায়ে ৫ থেকে ৬ টাকা মুনাফা হবে। আর খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা মুনাফা করবেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যে প্রতি কেজি আলুতে মজুতদাররা মুনাফা নূ্যনতম ১২ থেকে ১৫ টাকা মুনাফা করছেন।
তাই সিস্নপ বাণিজ্য করতে মজুতদাররা খুব বেশি দুশ্চিন্তা করছেন না। বরং তারা ধরেই নিয়েছেন, সরকারের এই চাপাচাপিতে তাদের মুনাফা আগের মতোই থাকবে। এ কারণে তারা নূ্যনতম দাম নির্ধারণ করে দিয়ে বস্নাঙ্ক প্রাইজে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে আলু বেচছেন।
একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিন তারা মজুতদারদের কাছ থেকে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা নূ্যনতম দাম ধরে আলু কিনেছেন। এসব মজুতদাররা তাদের কোনো পাকা রশিদ দেননি। তবে বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট থাকায় তারা মোটামুটি ভালো দামেই আলু বিক্রি করতে পেরেছেন। তাই কেউ কেউ নূ্যনতম দামের সঙ্গে আরও এক-দেড় টাকা যোগ করে মজুতদারকে বিল পরিশোধ করেছেন।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের এক পাইকার এ প্রসঙ্গে বলেন, নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট বিশ্বস্ততা রয়েছে। এ কারণে বস্নাঙ্ক প্রাইজে পণ্য বিক্রির বিষয়টি তারা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। শুধু আলুই নয়, অন্যান্য পণ্যের সংকটের সময়ও একই কৌশলে বেচাকেনা হয় বলে জানান তারা।
এদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী আলু সিন্ডিকেট থাকা এবং মজুতকৃত আলু থেকে হাজার কোটি টাকা মুনাফা লাভের টার্গেটের কথা অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হলেও সবাই মুনাফা করবেন কিন্তু মুনাফা কিছুটা কম হবে। কিন্তু এটাও অনেকে মানতে পারছেন না। এ কারণে আলু বিক্রি বন্ধ রয়েছে। তার দাবি, কোল্ড স্টোরেজের বেশির ভাগ আলুর মালিক এখন সিস্নপধারী মজুতকারী। কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের এখন আর বেশি আলু নেই। অনেক পেশাজীবী ও চাকরিজীবী হিমাগার থেকে আলু কিনে সিস্নপ নিয়ে গেছেন। এখন তারা যদি আলু বিক্রি না করেন সেক্ষেত্রে ক্লোড স্টোরেজের মালিকদের কিছুই করার নেই।
তবে আলুর একাধিক পাইকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সিস্নপ বাণিজ্য সব সময় থাকলেও এখন তা ভিন্ন কৌশলে শুরু হয়েছে। আলুর মজুতদার সিন্ডিকেটের কলকাঠি নাড়ছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু বাজারে বিক্রি করা যাবে না। তাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। ভোক্তা অধিদপ্তর যে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে আলুর বাজার সহসাই নিয়ন্ত্রণে আসবে এমনটা মনে করেন না তারা।
এদিকে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও গত কয়েকদিনে সিস্নপ বাণিজ্য জমে ওঠার কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, তাদের পক্ষে পাহারা দিয়ে কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু বের হওয়া বন্ধ করা সম্ভব না। এছাড়া পাকা রশিদে আলু বিক্রি হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
জেলা পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, পাকা রশিদ ছাড়াই পাইকাররা কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু কিনে এক শহর থেকে আরেক শহরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব পণ্য পরিবহণে তাদের কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে না। ট্রাকে পণ্যের চালানের পাশাপাশি পাকা রশিদ আছে কি না তা পরখ করলে ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বেশখানিকটা দমানো যাবে বলে মনে করেন তিনি।