সরকার পতনের এক দফা দাবিতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে সিলেট পর্যন্ত রোডমার্চ করেছে বিএনপি। টানা কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১৬০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন দলটির নেতাকর্মীরা। সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে এ রোডমার্চ আয়োজন করে দলটি।
সকাল ১০টায় ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত রোডমার্চ-পূর্বক সমাবেশে দলটির সিনিয়র নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হরতাল-অবরোধসহ সব ধরনের কর্মসূচি করতে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তারা বলেন, বিএনপি হরতাল কর্মসূচি দেয় না বলে সামনেও আর দেবে না এমন প্রতিজ্ঞাও করে নাই। জনগণের চাপের কারণে এই অবৈধ সরকারকে মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার জন্য হরতাল-অবরোধসহ যা যা করা দরকার গণতান্ত্রিক পন্থায় সব ধরনের কর্মসূচি হবে। সেই জন্য সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এবারের আন্দোলন ডু অর ডাই। হয় মরবেন; নয়তো লড়বেন। দেশের মানুষকে মুক্ত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষের মালিকানা জনগণের কাছে ফেরত দেওয়া হবে।
তিন বিভাগের ওপর দিয়ে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচি উপলক্ষে নেতাকর্মীরা বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস ছাড়াও কয়েক হাজার মোটর সাইকেল নিয়ে যোগ দেন। মাথায় ব্যান্ড পরে, রং-বেরঙের গেঞ্জি গায়ে হাজারো নেতাকর্মী এ সময় সরকারবিরোধী বিভিন্ন সেস্নাগান দিতে থাকেন। পথে পথে বিভিন্ন এলাকার দায়িত্বশীল নেতা ছাড়াও বিগত নির্বাচনে দলের এমপি প্রার্থী, মনোনয়ন প্রত্যাশী, কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতার উপচেপড়া ভিড় আর উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে রোডমার্চ ভৈরব ব্রিজ, আশুগঞ্জ পার হয়ে সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সমাপনী সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। মাঝপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বরোড মোড়, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ মোড়, মৌলভীবাজারের শেরপুরে পথসভায় বক্তব্য রাখেন।
এই রোডমার্চের শুরুতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তারুণ্যের যে রোডমার্চ শুরু হয়েছে তা সরকার পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। দেশ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে তরুণ সমাজ আজ জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনা সরকারকে আর কোনো শক্তিই রক্ষা করতে পারবে না। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি আগুন দিয়ে মানুষ মারে না, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ায় না। পথচারীদের বস্ত্র হরণ করে না। এখনো হরতাল দেয়নি। হরতাল দেওয়া দরকার আছে? অবরোধ দেওয়ার দরকার আছে? আপনারা পালন করবেন? তিন প্রশ্নের উত্তরে নেতাকর্মীরা বলেন 'হঁ্যা'। এ সময় গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, 'আপনাদের রায় পেলাম।'
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সরকারকে সরকার বলা যায় না। এটা একটি রেজিম। এদের প্রতি শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষ নয়; বিদেশিদের আস্থা নেই। এই রেজিমকে সরাতে মুক্তিযুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম করতে হবে, এই মুক্তির সংগ্রামে বিজয়ী হতে হবে। তিনি বলেন, আজ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই। নতুন প্রধান বিচারপতিকে ছাত্রলীগের নেতারা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আর তিনিও তা গ্রহণ করেছেন। এর থেকেই সবাইকে পরিস্থিতি বুঝে নিতে বলেন আমীর খসরু।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলমের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিএনপি সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়ারেশ আলী মামুন, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসন, ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
সোয়া ১১টার দিকে সিলেটের উদ্দেশে বিপুলসংখ্যক গাড়িবহর নিয়ে রোডমার্চ শুরু করে বিএনপি। পথে পথে প্রত্যেক জেলার বিভিন্ন থানা-উপজেলার আরও নেতাকর্মী এতে যোগ দেন। একসময় রোডমার্চে গাড়িবহর আর নেতাকর্মীদের উপস্থিতি তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
রোডমার্চ কিশোরগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল বিশ্বরোড এলাকায় পৌঁছানোর পর জেলার আশুগঞ্জ, সরাইল বিশ্বরোডের মোড় ও কুট্টাপাড়া এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী এতে যোগদান করেন। এখানের পথসভায় বক্তব্য রাখেন দলের সিনিয়র নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান মোলস্না কচি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খোকন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মোহাম্মদ শামীম ও যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা এস এন তরুণ দে-সহ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা রোডমার্চকে স্বাগত জানিয়ে শোডাউন করেন।
দুপুরে রোডমার্চটি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে নতুন ব্রিজস্থ নর্থইস্ট আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে পথসভার আয়োজন করে জেলা বিএনপি। এ কর্মসূচি উপলক্ষে সকাল থেকে বিএনপিসহ অঙ্গ-সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন যান ও মোটর সাইকেলের বহর, ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে মিছিল আর সেস্নাগানের মাধ্যমে রোডমার্চকে স্বাগত জানান তারা।
তুমুল ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিকাল সাড়ে ৫টায় রোডমার্চ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে পৌঁছানোর পর সেখানে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে স্থানীয় নেতাকর্মীরা চার ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় রোডমার্চের জন্য ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে অপেক্ষা করেন। শেরপুরের সভায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ফ্যাসিবাদের দিন শেষ খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিশ্ব বিবেক ও গণতান্ত্রিক শক্তি এক দফা দাবির আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ভিপি মিজানের সঞ্চালনায় এ পথসভায় কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।
এরপর রাত পৌনে ৮টায় রোডমার্চের বহর সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে পৌঁছে। এ সময় প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে সমাবেশ হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া ও রাত হওয়ায় স্থায়ী কমিটির দুই নেতা গয়েশ্বর রায় ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্য দিয়ে সমাবেশ হয়।
এদিকে একই দাবিতে আজ রাজধানীতে পৃথক দুটি সমাবেশ করবে বিএনপি। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির উদ্যোগে আব্দুলস্নাহপুর পলওয়ে মার্কেট সংলগ্ন ময়দানে এবং ঢাকা দক্ষিণের উদ্যোগে যাত্রাবাড়ী শহীদ ফারুক সড়কে বিকাল ৩টায় এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া একইদিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বাদ জুমা সারা দেশে জেলা, মহানগর, থানা-উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে দোয়া মাহফিল ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হবে।