বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
walton
আপাতত সুখবর নেই

রিজার্ভ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

এম সাইফুল
  ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বাড়ছে উদ্বেগ। বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং আশানুরূপ রপ্তানি না বাড়ায় রিজার্ভ কমছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েও আমদানি ব্যয় কমাতে না পারা রিজার্ভ কমার অন্যতম কারণ। নিত্যপণ্যের বাইরেও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অনেক পণ্য আমদানি হচ্ছে। শিগগিরই রিজার্ভ বাড়ার কোনো লক্ষণও দেখছে না অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ সেপ্টেম্বর রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১.৭০ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সনাতন হিসাব পদ্ধতিতে রিজার্ভের পরিমাণ এখনো ২৭.৬৩ বিলিয়ন। কিন্তু আইএমএফ এই হিসাব মানছে না। কমপক্ষে ২৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে সংস্থাটি।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ছোট ছোট কিছু ঋণের অর্থ ছাড় হয়। ছোট ছোট এসব অর্থ ছাড়ে এক বিলিয়ন ডলারও হবে না। আগামী দুই মাস পর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকুর) আরেকটি পেমেন্ট দিতে হবে। তখন রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অর্থনীবিদরা বলছেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতেই হবে এর কোনো বিকল্প নেই। তবে ঋণনির্ভর নতুন প্রকল্প না নেওয়া উচিত। পাশাপাশি যে পরিমাণ লোক বিদেশে যাচ্ছে সেই তুলনায় রেমিট্যান্স আসছে না। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমদানি ব্যয় আরও যতটা সম্ভব হ্রাস করে রপ্তানি বৃদ্ধিতে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

এদিকে, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা রপ্তানির বিল শতভাগ বৈধ পথে আনছেন না। তারা আন্ডার ইনভয়েসিং বা পণ্যের দাম কম দেখিয়ে বাড়তি টাকা অন্যদেশে গ্রহণ করেন। অথবা কখনো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আনেন। এতেও অনেক ডলার বিদেশে চলে যায়। এমনকি ব্যবসায়ীরা টাকা পাচারের জন্য আমদানির সময় ওভার ইনভয়েসিং বা বেশি দাম দেখিয়ে বিদেশে পাঠায়। বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রম্নপের বিদেশে বিনিয়োগের তথ্য সরকারের কাছে আছে। তারা বৈধভাবে এসব টাকা পাঠায়নি।

অন্যদিকে, ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) নেতারা একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলেছেন, ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। যদিও কারা জড়িত এমন তথ্য দেননি। সরকার চাইলেই তাদের বের করতে পারে বলে জানান ব্যাংকাররা।

এর বাইরেও অনেকে ফরেক্স, বিটকয়েন ও অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছে। এতেও দেশ থেকে ডলার চলে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি অবৈধ এমটিএফই নামে একটি এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) কোম্পানি ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। তাদের অধিকাংশ টাকা হুন্ডি এবং বিটকয়েন বা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে গেছে। এখনো সারা দেশে এ ধরনের শত শত কোম্পানি নীরবে কাজ করছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বাভাবিক রাখতে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে আমদানির দায় হিসেবে ডলার সাশ্রয় হলেও বাস্তবে ডলারের মজুত বাড়ছে না। একেবারেই কমেনি তা নয়, তবে সেটি সন্তোষজনক নয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪৩২ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছরের একই মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৬৩৫ কোটি ডলারের।

এদিকে, ডলার খরচ কমাতে টাকার বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে আমদানি শুরু করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হওয়াতে সেখানেও খুব একটা সফলতা আসছে না। ভারতে বছরে মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত থেকে আমদানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে না। রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে তাদের মুদ্রায় আমদানি করার পরিকল্পনা থাকলেও নানা কারণে তা শুরু হয়নি।

ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না হওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী নয় প্রবাসীরা। হুন্ডির মাধ্যমে ডলারের দাম বেশি পাচ্ছে। ফলে সবাই হুন্ডির পেছনে ছুটছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি উভয় খাতে ১১০ টাকা। রেমিট্যান্সের প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৭৫ পয়সা পাচ্ছেন। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার দর বাজারভিত্তিক হলে এই মুহূর্তে ডলারপ্রতি ১১৮-১২০ টাকা হবে।

নিয়ন্ত্রণমূলক ডলারের দর হওয়ায় বিকল্প উপায়ে অর্থ আনছে। কিন্তু সরকার ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার ঝুঁকি নিচ্ছে না। এতে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। নির্বাচনের আগে সরকার এই ধরনের 'রাজনৈতিক সাহস' দেখাতে যাবে না বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, গত এক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার পরও রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতির কারণে রিজার্ভ কমছে।

সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এদিন প্রকৃত রিজার্ভ ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জুলাই ও আগস্ট মাসের আমদানি বিল বাবদ ১৩১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে সবচেয়ে বেশি ডলার ক্ষয় হচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই অর্থ আগের বছর একই সময়ের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাইয়ে সুদে আসলে বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছিল ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ ছিল ১১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এই বছরের জুলাইয়ে তা হলো ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আর সুদ হলো ১১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, যা গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ছয় কোটি ৪৭ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। আগের অর্থবছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। আর এখন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮২.৮৫ বিলিয়ন ডলার।

জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। আর গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৬ হাজার। তাই এ বছর রেমিট্যান্স বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। সরকারের প্রণোদনা দেওয়া সত্ত্বেও তারা ব্যাংক বিমুখ।

এদিকে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৮ হাজার ১০২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন এসেছে ৪ কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ মাসে রেমিট্যান্স আসতে পারে ১৪৮ কোটি ডলারের মতো। গত আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আগস্টে আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এক মাসের ব্যবধানে প্রবাসী আয় কমে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার।

এদিকে রপ্তানিতেও মিলছে না কোনো সুখবর। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য খাতে ৬২ বিলিয়ন এবং সেবা খাতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৫.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সর্বশেষ অর্থবছরেও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি বিরাজ করছে।

রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বিদেশে অবস্থিত মিশনগুলোর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রবৃদ্ধি এক শতাংশেরও কম। এদিকে রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক পণ্য। বিদেশি দূতাবাসগুলোতে কর্মাশিয়াল উইং থাকলেও খুব বেশি সুখবর নেই। অথচ দেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখার কথা মিশনগুলোর। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।

গত মার্চে রিজার্ভ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এপ্রিলে তা ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে। মে-জুন মাসে আকুর দেনা পরিশোধের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়ে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে এসেছিল।

কিন্তু জুলাইয়ে আকুর দেনা ১০৯ কোটি ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ আবার জুলাই মাসে ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে। গত পাঁচ মাস ধরে রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ছিল। এবার আকুর দেনা পরিশোধের পর আবার নেমে গেল ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ফারুক আহমেদ সিদ্দীকি বলেন, রেমিট্যান্স কেন কমছে এটি সরকারের উচিত খতিয়ে দেখা। কারণ বাংলাদেশ থেকে যে হারে শ্রমিক যাচ্ছে, সেই হারে রেমিট্যান্স আসছে না। এ খাত থেকে আরও বেশি ডলার আয় হতে পারে। যদিও ডলারের রেট একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে ডলারের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু সরকার সেই ঝুঁকি নিচ্ছে না। আর রপ্তানি তো চাইলেই বাড়ানো সম্ভব না। সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যতা বাড়াতে হবে। শুধু গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর করলে চলবে না।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমদানি কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। ডলার যতটুকু সম্ভব সঞ্চয়ের চিন্তা করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে যেভাবে খরচ হয় তাতে অনেক ডলার অপচয় হয়। ব্যক্তি স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তারা প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেন। সামান্য কিছু কিনতে গেলেই বিদেশে সফর করেন। এয়ারলাইন্সগুলোর প্রথম শ্রেণির টিকিট কারা কিনেন খোঁজ নিলেই দেখা যাবে সব সরকারি কর্মকর্তা। তাই সরকারের উচিত এগুলোর দিকে নজর দেওয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
shwapno

উপরে