বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আতঙ্ক ছড়িয়ে ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখ করার ছক

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:২২
আতঙ্ক ছড়িয়ে ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখ করার ছক

নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপির হরতালের ডাক এবং ভোট বর্জনের কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই শুক্রবার রাতে ঢাকার গোলাপবাগে যাত্রীবাহী চলন্ত ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দেওয়া আগুনে ৪ জন নিহত ও ৮ জন গুরুতর দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এর ওপর একই রাতে বিভিন্ন স্থানে বিপুলসংখ্যক ভোটকেন্দ্র ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ নানামুখী হামলার ঘটনা সাধারণ মানুষকে আরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। যা ভোটের মাঠে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

তাদের ভাষ্য, এবারের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকা ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে অনেকটা এক তরফা ভোটের মাঠে রয়েছে। তাদের দাপটে জাতীয় পার্টির উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল বিএনপিসহ ছোটখাটো কিছু দল কাগজে-কলমে ভোটের মাঠে থাকলেও বাস্তবে তাদের উপস্থিতি শুরু থেকেই নেই বললেই চলে। ফলে এই পানসে ভোটে সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ এমনিতেই অনেক কম। এর ওপর ভোটের দিন শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একযোগে নাশকতার ঘটনা আকস্মিক বেড়ে যাওয়ায় নিরপেক্ষ ও সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

ঢাকায় বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোট দিতে তারা অনেকেই শনিবার সকালে কিংবা রাতে সপরিবারে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা

করে রেখেছিলেন। তবে শুক্রবার রাতে গোলাপবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে এবং বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর তারা সে ইচ্ছে উধাও হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রাম থেকেও তাদের আত্মীয়স্বজন বাড়ি না আসার জন্য অনুরোধ করছেন।

অন্যদিকে ভোটাররা কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, গত দুই টার্মে তারা আগ্রহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে পারেননি। তারা কেন্দ্রে যাওয়ার আগে কে বা কারা তাদের ভোট দিয়ে গেছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অনেকেই হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তাই সহিংসতার আশঙ্কায় মাথায় নিয়ে তাদের অনেকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে চান না।

এদিকে ঢাকা-৫ আসনের একজন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশে বিপুলসংখ্যক আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে দুর্বল প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ওইসব আসনে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা কম। কিন্তু ঢাকা-৫ এ ভোটের লড়াই হবে তিন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে। যারা তিনজনই আওয়ামী দলীয় নেতা। তাই সাধারণ ভোটাররা এমনিতেই ভীত-সন্ত্রস্ত। এ ছাড়া আওয়ামী সমর্থক ভোটাররাও ভোট দিতে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন। কেননা কাকে ভোট দিলে পাছে কার বিরাগভাজন হতে হয় অনেকের মধ্যেই এই ভয় রয়েছে।

এদিকে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাজসাজ প্রস্তুতির কথা জানানো হলেও সংঘাত-সহিংসতার কারণে বিপুলসংখ্যক ভোটার যে ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না এ বিষয়টি ভোটারদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের ভাষ্য, প্রচার-প্রচারণার মাঠেও বিপুলসংখ্যকর্ যাব-পুলিশ ও আনসার মোতায়েন থাকলেও একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৫ জন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন অর্ধ সহস্রাধিক। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে কয়েক ডজন। তাই ভোটের দিন আসা-যাওয়ার পথে কিংবা ভোটকেন্দ্রে কোনো ধরনের নাশকতা-হামলা কিংবা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে না এমনটা আশা করা যায় না।

এ ছাড়া ভোটের মাঠে গুপ্তহত্যা ও চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে তাদের এমন আশঙ্কা প্রকাশ করার কথা না। তাই ভোট দিতে কোনো বিপদে পড়ার ঝুঁকি নিতে চান না সাধারণ ভোটাররা।

এদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কায় মার্কিন নাগরিকদের জন্য অতিসম্প্রতি যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে, তাও সাধারণ ভোটারদের ভীতির মাত্রা আরও একধাপ বাড়িয়েছে।

উলেস্নখ্য, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কায় বাংলাদেশে মার্কিন নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। এই অবস্থায় দূতাবাস মার্কিন নাগরিকদের বেশকিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে বলেছে। গত বৃহস্পতিবার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সতর্কবার্তায় বলা হয়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। মনে রাখা উচিত, নির্বাচন যদিও শান্তিপূর্ণ হবে বলেই আয়োজন করা হয়েছে, তবে তা সংঘর্ষ ও সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন বা পরের দিন বা সপ্তাহগুলোতে সামান্য বা কোনো ধরনের পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই সহিংসতা ঘটতে পারে।

এদিকে সারা দেশে গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৫টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে ট্রেনসহ ৬টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগুন দেওয়া হয়েছে ৯টি স্থাপনায়। এর মধ্যে ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি উচ্চবিদ্যালয়।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ১৮ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্নার পঞ্চবটী মোড়ে এক পিকআপ ভ্যানে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আর রাজধানীর গোপীবাগে রাত ৯টা ৫ মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়। ভয়াবহ এ আগুনে পুড়ে মারা গেছেন চারজন।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, শুক্রবার রাত ১২টার পরপর হবিগঞ্জের চুনারঘাটের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাত দেড়টার দিকে গাজীপুরের চন্দনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাত পৌনে তিনটার দিকে গাজীপুরের টিএনটি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। অন্যদিকে সিলেটের সাতমাইল এলাকায় রাত পৌনে তিনটার দিকে একটি ট্রাকে আগুন দেয় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। একই সময় ফেনীর লালপুরে দুটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাত তিনটার কিছু সময় আগে কক্সবাজারের রামুতে একটি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর। সরকারি এ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে ভোর সাড়ে চারটার দিকে। আর চট্টগ্রাম মহানগরীর নিশ্চিন্তপাড়া এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয় ভোর পাঁচটার দিকে।

শনিবার ভোরে চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ডে অবস্থানরত আনন্দ পরিবহণ নামে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার খোকন মিয়া দগ্ধ হন। আহত হয়েছেন বাসটির চালক নাছির উদ্দিন বিপস্নব। চালক জানান, হেলপারসহ তারা দুজন বাসে ঘুমিয়েছিলেন। আগুন লাগার পর তারা লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। ঘটনাস্থলে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি।

সকাল ছয়টার কিছু আগে সীতাকুন্ডে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর আধাঘণ্টা পর শেরপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে সকাল আটটার দিকে। ময়মনসিংহের নান্দাইলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে সকাল সোয়া নয়টার দিকে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা জানান, গত ৩ জানুয়ারি একদিনে সংঘর্ষের ঘটনায় ২ জনের মৃতু্য হয়েছে। এ ছাড়া গত ৯ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় ৫ জনের প্রাণহাহির ঘটনা ঘটেছে। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৫৬টি জায়গায় নির্বাচনী সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের সংগঠন মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের হিসেবে অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৯০টি নির্বাচনী সংঘাতের ঘটনায় ২৭৯ জন আহত হয়।

তিনজন গুলিবিদ্ধ ও তিনজন নিহত হয়। আর ১ জানুয়ারি থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনী সংহিসতায় ৩ জন গুলিবিদ্ধ ও ২ জন মারা যায়।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ নেই জানিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, '৩০ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিতে আসবে না। বাংলাদেশ আবারও ২০১৪ এবং ২০১৮ এর মতোই আরেকটি নির্বাচন দেখতে যাচ্ছে।'

এই নির্বাচন পর্যবেক্ষক বলেন, 'নির্বাচন নিয়ে ৬০ শতাংশ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। বাকি ৪০ শতাংশ মানুষ ডিভাইডেড যে, কী হবে; না হবে। আর নতুন ভোটাররা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। তাই ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিতে আসবে না। কারণ নিজেদের মধ্যেও কোন্দল আছে। বাংলাদেশ আরেকটি নির্বাচন দেখতে যাচ্ছে যেই নির্বাচনের রেজাল্ট আগের মতোই হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে