রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

কোকেন পাচারের ট্রানজিট বাংলাদেশ!

গাফফার খান চৌধুরী
  ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শাহজালালে জব্দ ৮ কেজি ৩শ' গ্রাম কোকেন

জব্দ হওয়া শত কোটি টাকার কোকেনের গন্তব্য ছিল পার্শ্ববর্তী একটি দেশে। কোকেন আমদানির সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে কাজ চলছে। মাদক মাফিয়া চক্রে বাংলাদেশি কেউ আছে কিনা জানতে তদন্ত অব্যাহত আছে। রিমান্ডে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে কোকেনসহ গ্রেপ্তার বিদেশি নাগরিককে। আগামীকাল রোববার ঢাকার সিএমএম আদালতে গ্রেপ্তার আসামির রিমান্ডের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি রাতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়া শত কোটি টাকা মূল্যমানের প্রায় সাড়ে ৮ কেজি কোকেনের গন্তব্য ছিল পার্শ্ববর্তী একটি দেশে। জব্দ হওয়া কোকেন দেশটিতে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়ে যায় কোকেনের বড় চালানটি। জব্দ হওয়া কোকেনগুলো দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপাদিত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বাংলাদেশে কোকেনের চালানটি ধরা না পড়লে স্থল পথে পাচারের টার্গেট ছিল। বড় ধরনের এই মাদকের চালানের সঙ্গে কোন কোন দেশের মাদক মাফিয়ারা জড়িত তা জানার চেষ্টা চলছে। এমনকি বাংলাদেশি কোনো মাদক মাফিয়া কোকেনের জব্দ হওয়া চালানটির সঙ্গে জড়িত কিনা সেটি নিশ্চিত হতে রীতিমতো সম্মিলিত তদন্ত চলছে। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা একযোগে কাজ করছে জব্দ হওয়া কোকেনের আদ্যোপান্ত জানতে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশে কোকেনের ব্যবহার অত্যন্ত কম। তবে বাংলাদেশি বেশ কিছু মাদক মাফিয়া আছে যারা কোকেনসহ নানা ধরনের মাদক চোরাচালানে জড়িত। বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের মধ্যে

এককভাবে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকার কোকেন কেনার অতীত রেকর্ড আছে। কিন্তু এককভাবে একশ' কোটি টাকার কোকেন কেনার মতো মাদক মাফিয়ার সন্ধান মেলেনি। তবে অনেক মাদক মাফিয়া মিলে একশ' কোটি টাকার কোকেন কিনেছিল তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কোকেনের এতবড় চালানের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কারণ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এজন্যই জব্দ হওয়া কোকেন নিয়ে রীতিমতো শোরগোল চলছে। বিদেশি মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশি মাদক মাফিয়াদের জব্দ হওয়া কোকেনের বিষয়ে কোনো যোগসূত্র বা যোগাযোগ আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানা সূত্রে জানা গেছে, জব্দ হওয়া মাদকের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জিলস্নুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় মাদক বহনকারী মালাউয়ের নারী নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো (৩৫)। মামলাটির তদন্ত করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ওবায়দুর রহমান। সার্বিক বিষয়টি তদারকি করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক জিলস্নুর রহমান পুরো বিষয়টি মনিটরিং করছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার নারীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়। আদালত শুনানি শেষে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে তাকে বৃহস্পতিবারই ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে আদালত আগামীকাল রোববার রিমান্ডের শুনানির দিন ধার্য করেন। গ্রেপ্তার আসামি যে দেশের নাগরিক, সেই মালাউতে কোকেন উৎপাদিত হয় না।

এদিকে বুধবারই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থানাধীন উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত হোটেল এনফোর্ড ইন থেকে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ মোহাম্মেদি আলি নামে তানজানিয়ার এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্র্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে বিমানবন্দর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন।

তদন্তকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সফলভাবে বিমানযোগে বাংলাদেশে আসেন তানজেনিয়ার ওই নাগরিক। এরপর তিনি হোটেলে উঠেন কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। প্রথমে ছোট চালানটি পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হতে পারে। সেই চালানটি সফলভাবে পৌঁছার পরই হয়তো দ্বিতীয় চালানটি বিমানবন্দর থেকে খালাস করা হয়। দুটি ঘটনার মধ্যে বিশেষ কোনো যোগসূত্রে আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এত বড় একটি কোকেনের চালান বিমানবন্দর থেকে কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই খালাস হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে বিমানবন্দরের কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্টদের কেউ জড়িত কিনা সে বিষয়ে গভীর তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোকেনের চালান ধরা পড়েছে। জব্দ হওয়া ওইসব কোকেন এসেছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জন্য। বাংলাদেশকে শুধু মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে। জব্দ হওয়া কোকেন কোন দেশে এবং কাদের কাছে পাঠানোর কথা ছিল তা জানতে গ্রেপ্তার নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া বাংলাদেশের কোনো মাদক মাফিয়া এর সঙ্গে জড়িত কিনা সেটিও জানতে সম্মিলিতভাবে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তার নারী মালাউইতে নার্স পেশায় জড়িত। এর আগেও তিনি ব্যবসায়িক পারপাসে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক তানভীর মমতাজ জানান, গত বছর তিনি গার্মেন্টস ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এবারও তিনি বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টসের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আসেন। অন অ্যারাইভাল ভিসা নেওয়ার জন্য তিনি তার পরিচয় লুকিয়ে গার্মেন্টস ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থান করা একজন বিদেশির কাছে কোকেনগুলো হস্তান্তর করার কথা ছিল তার। এরপর ওই বিদেশির সঙ্গে চালানটি পার্শ্ববর্তী দেশের মূল গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। চোরাচালান সম্পন্ন করে গ্রেপ্তার নারীর আগামী ৪ ফেব্রম্নয়ারি নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। চালানটির সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ জড়িত কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১০ জুন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ২ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হয় মরক্কো থেকে আসা ভারতীয় নারী সালোমি লালরামধারি। জব্দ কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারতের নয়াদিলিস্ন। ২০১৩ সালের ১১ জুন ঢাকার কারওয়ান বাজারের হোটেল লা ভিঞ্চি থেকে প্রায় ৩ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হয় পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটা। মামলার আসামি এখনো কারাগারে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি।

২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় আড়াই কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার হন পেরুর আরেক নাগরিক জেইম বার্গলে গোমেজ। এ মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আসা সূর্যমুখী তেলের ড্রামে ভরা তরল কোকেন ধরা পড়ে। জাহাজে একটি কনটেইনারে আসা ১০৭টি তেলের ড্রামের মধ্যে একটিতে কোকেন পাওয়া যায়। ড্রামটিতে প্রায় ১৮৫ কেজি সানফ্লাওয়ার তেলের পরিবর্তে ছিল তরল কোকেন।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ২৭০ কেজি হেরোইন ও পাঁচ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ বাংলাদেশি নাগরিক দেওয়ান রাফিউল ইসলাম হিরো ও জামাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে শ্রীলংকান পুলিশ। এছাড়া ডিবি পুলিশ গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল থেকে বাত সোয়ানা নামে এক আফ্রিকান নারীকে প্রায় ৫ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করে। তিনি খেয়ে পেটের ভেতরে করে কোকেনগুলো নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে তার পেটা ব্যথা শুরু হলে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ডিবি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই আফ্রিকান নারী জানান তার পেটে কোকেন রয়েছে। যা তিনি খেয়ে এনেছেন। নির্ধারিত সময়ে একজন ব্যক্তির বিশেষ ট্যাবলেট নিয়ে তার কাছে আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে পেট ওয়াশ করে কোকেনগুলো বের করে। এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে