বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১

ফের সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢেউ

অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ৬০-৭০ হাজার গত এক মাসে এসেছে অন্তত ২০ হাজার সহযোগিতা করছেন রোহিঙ্গা দালালরা
যাযাদি ডেস্ক
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ফের সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢেউ

দেশে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা বাড়ছে। এক শ্রেণির রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে নৌকাযোগে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফে আসছেন রোহিঙ্গারা। আশ্রয় নিচ্ছেন বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে। এ ছাড়া বাসা ভাড়া করেও থাকছেন কেউ কেউ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা বলা হলেও জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের ধারণা মঙ্গলবার পর্যন্ত এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। এ ছাড়া মংডু সীমান্তে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন আরও ৬০ থেকে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সতর্ক পাহারা এড়িয়ে নতুন করে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরকে কেন্দ্র করে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকেই দালালদের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন বা চেষ্টায় আছেন বলে কক্সবাজারের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। উখিয়া ও টেকনাফের স্থল ও নৌ পথে সীমান্তের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের চলমান যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। মংডু টাউনে থাকা সেনা ও বিজিপির দুটি ব্যারাক (ব্যাটালিয়ন) দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। গোলাগুলির পাশাপাশি দুই পক্ষ থেকে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেল, গ্রেনেড ও বোমা। মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলাও চালানো হচ্ছে। এর আগে যুদ্ধের তীব্রতায় বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর ড্রোন হামলায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হন। তখন স্থানীয় রোহিঙ্গারা ড্রোন হামলার জন্য আরাকান আর্মিকে দায়ী করেন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানান, মংডু টাউনের পাশে লাগোয়া পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুলস্নাপাড়া দখল করে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। মংডুসহ আশপাশের রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এরই মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার

রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে রয়েছেন। রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সহযোগিতা করছেন স্থানীয় ও রোহিঙ্গা দালালরা।'

স্থানীয়রা জানান, কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা কৌশলে অনুপ্রবেশ করছে। এ কাজে দালালরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জন প্রতি পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের এপারে আসতে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই দালাল চক্র টেকনাফ সীমান্তের জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল দিয়ে সীমান্তের দায়িত্বরত বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৌশলে রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

টেকনাফের নয়াপাড়ার আশ্রয়শিবিরের ই-বস্নকের অন্তত ৩৪টি ঘরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছেন জানিয়ে ওই বস্নকের রোহিঙ্গা নেতা নুরুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'কমবেশি সব রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরে তারা পৌঁছাচ্ছে।'

উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, বালুখালী আশ্রয়শিবিরেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে। লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে তিন দিন আগে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা হাবিব উলস্নাহ (৪৫) জানান, মর্টার শেলের আঘাতে তাদের ঘর পুড়ে গেছে ১১ দিন আগে। এরপর পাশের প্যারাবনে লুকিয়ে ছিলেন কয়েক দিন। সাত দিন অপেক্ষার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার নৌকা পেয়েছেন তারা।

টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছেন জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয়শিবিরগুলোতে থাকা আত্মীয়-স্বজনের (পুরানো রোহিঙ্গা) ঘরে আছেন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও আহত রোহিঙ্গাও আছেন। তাদের আশ্রয়শিবিরে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'

বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সীমান্তে বিজিবির পক্ষে সর্বোচ্চ সর্তকর্তার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। গত এক মাসে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী ৪ হাজার ৫০৬ জন রোহিঙ্গাকে আটকের পর ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত কয়েকদিনে নানাভাবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য জানালেও সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা মঙ্গলবার পর্যন্ত এ সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার কথা বলছেন।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

টেকনাফের ইউএনও মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা কাজ করছেন। অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ তারা ঠেকিয়েছেন। তবে টেকনাফে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের পরে যেসব লোক রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দিয়েছে বা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।'

রোহিঙ্গাদের অধিকার সংগঠন 'আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, 'জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা-সংকটের গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ কারণে নতুন করে আরও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনী লড়াইয়ে রোহিঙ্গারা নির্মূল হচ্ছে। লড়াই বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ দরকার।'

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, 'নাফ নদী ও সীমান্তে কড়াকড়ির পরও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ স্থানীয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এখনো পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে। তারাও যদি বাংলাদেশে চলে আসে, তাহলে নতুন সংকট দেখা দেবে। যেকোনো মূল্যে অনুপ্রবেশ ঠেকানো দরকার।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে