শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবসরভাতার জন্য শিক্ষকদের কান্না

নুর মোহাম্মদ
  ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

চাকরি জীবনের জমানোর টাকা পেতে বেসরকারি শিক্ষকদের অপেক্ষা করতে হয় ৫ থেকে ৭ বছর। ততদিনে কেউ টাকার মুখ না দেখে কেউবা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। কেউ মেয়ে বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারেন না। অথচ অবসরে পর পরই তার গচ্ছিত টাকা দেয়ার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে জাতি গড়ার কারিগরিরা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নিদারুন কষ্ট আর ভোগান্তিতে পড়ছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের মোট ৬ শতাংশ (বর্তমানে ১০ শতাংশ) কেটে রাখে সরকার। যা অবসরের পর লভাংশসহ দেয়া হয়। অবসরে যাওয়ার পর একজন শিক্ষককে এ টাকা তুলতে গিয়ে নানা হয়রানি, বিড়ম্বনা শিকার হতে হয়। হয়রানির সঙ্গে যোগ হয় ঘুষ দেয়ার মতো ঘটনাও। তারপরও মিলে না কাঙ্ক্ষিত টাকা। অনেকেই জমানো টাকা তুলতে দ্বারস্ত হন মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। কখনো তাদের ডিও লেটার নিয়েও অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট অফিসে জমা দিলেও টাকা মিলে না।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ সমস্যা নতুন নয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা মাঝখানে কিছুটা কমলেও ৮ম পে-স্কেল ইসু্যতে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে সরকার অষ্টম পে-স্কেল অনুযায়ী শিক্ষকদের অবসর-কল্যাণ সুবিধাও দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বাড়ে। এতে অবসরত্তোর টাকাও দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বাড়ে। সেজন্য ২০১৫ সালের জুনের আগের অবসরে গেছেন এমন শিক্ষক-কর্মচারীর প্রায় সবার টাকা দেয়া হলেও ২০১৫ জুলাই মাস থেকে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দুই বোর্ডকে।

অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে প্রতিমাসে ৪ শতাংশ টাকা কেটে রাখা হতো। ওই টাকা ব্যাংক রেখে যে লভাংশ আসত তা দিয়ে তাদের অবসর সুবিধা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী সারাদেশে শিক্ষকদের মাসিক চাঁদা বাবদ আসত ১৮ কোটি টাকা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পাওনা টাকা দিতে প্রতি মাসে প্রয়োজন ৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি ১৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের জুন মাসে নতুন ৮ম বেতন স্কেল ঘোষণার পর ঘাটতি পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে আদায় হয় ৩৫ কোটি টাকা। খরচ হয় ৭০ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৩৫ কোটি টাকা। এই অর্থ সংকট কাটাতে ২০১৭ সালে অবসর ভাতার চাঁদা ৬ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে সেই সিদ্ধান্তটি স্থগিত করা হয়। পরে চলতি বছর ১৯ এপ্রিল থেকে অবসর সুবিধার জন্য মাসিক ৬ শতাংশ ও কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৪ শতাংশ চাঁদা কর্তন করা হচ্ছে। এছাড়া সরকার অবসর বোর্ডে ৮০০ কোটি ও কল্যাণ ট্রাস্টকে ১৫০ কোটি টাকা এককালীন অনুদান দেয়। এ টাকা দিয়ে গত অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়ায় শিক্ষকদের আবেদনের সংখ্যা কমে এসেছে।

এ ব্যাপারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী যায়যায়দিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ আবেদন পড়েছে তা নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ২ হাজার কোটি টাকা। এজন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তিনি জানান, এক সময় ৭ থেকে ৮ বছর অপেক্ষা করতে হতো। সেটি এখন ৩ থেকে ৪ বছরে নেমে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রী ৫০০ কোটি টাকা সিডমানি এবং একশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেন। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আরও দেড়শ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়ায় পাঁচ বছরের গ্যাপ এখন তিন বছর এসে দাঁড়িয়েছে।

অবসর বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ৬ শতাংশ হারে মাসিক চাঁদা কর্তন করায় এখন ৫৬ কোটি টাকা মাসিক সঞ্চয় হচ্ছে। আর মাসিক পরিশোধ করতে হবে ৭৪ কোটি টাকা। এ হিসেবে প্রতিমাসে প্রায় ১৯ কোটি টাকা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। বর্তমানে ২২ হাজার আবেদন জমা আছে। গত বছর থেকে শিক্ষকদের বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়েছে সরকার। ৮ম স্কেল ও ইনক্রিমেন্টসহ সব আবেদন নিষ্পত্তি করতে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন।

একই পরিস্থিতি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টেও। এ বোর্ডে প্রায় ২০ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ১৩০০ কোটি টাকা বেশি। বর্তমানে ৪ শতাংশ হারে প্রতিমাসে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় হচ্ছে ৩০ কোটি টাকা। আর অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের দিতে হচ্ছে ৫০ কোটি টাকা। প্রতিমাসে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ২০ কোটির বেশি। এরসঙ্গে গত বছর শিক্ষকদের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেয়ায় ঘাটতি পরিমাণ আরও ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আবেদনগুলো পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৯১৩ কোটি টাকা। পাঁচ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের জন্য প্রয়োজন আরও ৪০০ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু যায়যায়দিনকে বলেন, কল্যাণ ট্রাস্টে অবসর ট্রাস্টের মতো সংকট এতটা প্রকট না। তবে ৮ম স্কেল ও ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট নিয়ে আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটা কাটানো চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সব আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের আবেদনের টাকা দেওয়ার কাজ চলছে। শিক্ষকদের এ সংকট দূর করতে প্রত্যেক বাজেটেই এ খাতে বরাদ্দ রাখার দাবি জানাচ্ছি।

হয়রানি কমাতে অনলাইনে আবেদন:

শিক্ষকদের হয়রানি কমাতে আবেদন অনলাইনে নেয়া থেকে শুরু করে চেক শিক্ষকের ঠিকানায় পাঠানো উদ্যোগ নিয়েছে অবসর বোর্ড। এতে বোর্ডের অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন আর শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার টাকা পাওয়ার জন্য হয়রানির শিকার হতে হয় না। কোনো দালাল হয়রানি করার সুযোগ পায় না বলে দাবি করেছেন বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী। তিনি বলেন, এখন টাকা পাওয়ার আবেদন করতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের সশরীরে উপস্থিত হওয়ার দরকার নেই। অনলাইনে প্রয়োজনীয় সব কাগজ স্ক্যান করে পাঠিয়ে দিলেই হয়। অনলাইনে আবেদনপত্র জমা দেয়া ও কাগজপত্র জমা দেয়ার পদ্ধতি চালু হওয়ায় তারা এখন নিজ নিজ উপজেলা বা প্রতিষ্ঠান থেকেই আবেদন পাঠাতে পারেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকরা তার আবেদনটি এখন কোন পর্যায়ে আছে তাও জানতে পারবেন। এ ব্যাপারে একটি কল সেন্টারও চালুর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কল সেন্টার চালুর আগে ম্যানুয়াল নাম্বার ৯৬৬২১৮২-এ কল করলেই প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন।

কর্মকর্তারা বলেন, আবেদনের হয়রানি কমাতে শিক্ষকের আবেদনপত্রের সত্যতার জন্য প্রধান শিক্ষক বা স্কুল কমিটির সভাপতির স্বাক্ষরেরও প্রয়োজন হয় না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সেলের মাধ্যমে আবেদনের সত্যতা করা হচ্ছে। অবসরের টাকাও আর চেকের মাধ্যমে পাঠানোর দরকার হবে না। অনলাইনের মাধ্যমে তা ব্যাংকে পাঠানো যাবে। টাকা পাওয়ার জন্য এখন আর কোনো মধ্যস্থতাকারী বা দালালের দরকার হয় না বলে দাবি করেন কর্মকর্তারা। আগে অবসর সুবিধা বোর্ডে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে আসা আবেদনের পাহাড়সম এক বিশাল স্তূপ ছিল। সেটি এখন অনেকাংশে কমে আসছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79840 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1