দীর্ঘমেয়াদি আমাশয়ের সমস্যার মধ্যে একটি হলো ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম তথা আইবিএস। পৃথিবীর মানুষ পরিপাকতন্ত্রের যে সমস্যাটির জন্য সবচেয়ে বেশি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে এবং যে সমস্যাটির জন্য জীবনযাপনের মানে ঘাটতি হয় তা হলো আইবিএস। রিসার্চ অনুযায়ী একটি দেশের লোকসংখ্যার ২০ শতাংশ আইবিএসের লক্ষণ বহন করে এবং ১০ শতাংশ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য আসে। পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের প্রায় দুই থেকে তিন গুণ এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়। যারা আইবিএস নামক দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় সমস্যায় ভুগে তাদের একটি অংশের উক্ত রোগের সঙ্গে থাকে বদহজম, দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি, মাসিকের সময় ব্যথা এবং পুরো শরীর ব্যথাসহ এই জাতীয় সমস্যা।
আইবিএসের কারণ ও প্রভাবক হিসেবে বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো দুটো ভাগে ভাগ করা যায় : মনোসামাজিক ও শারীরবৃত্তীয়। মনোসামাজিক কারণের মধ্যে আছে দুশ্চিন্তা ও হতাশা। এছাড়া, হঠাৎ অধিক মানসিক চাপও আইবিএসকে প্রভাবিত করে। দেখা গেছে, আইবিএসে আক্রান্ত রোগীরা অল্প সমস্যা হলেই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তারা পরিস্থিতি সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।
শারীরবৃত্তীয় সমস্যার মধ্যে রয়েছে অন্ত্রনালীর অস্বাভাবিক নাড়াচাড়া, অন্ত্রনালীর বেশি স্পর্শকাতর হয়ে পড়া, এলার্জি ও ইনফেকশন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ দুধ ও গম জাতীয় খাবার সহ্য ক্ষমতা কম; অর্থাৎ এ ধরনের খাবার খাওয়ামাত্রই তাদের আমাশয়ের সমস্যা শুরু হয়ে যায়।
আইবিএসের রোগীদের দুই ধরনের সমস্যাই হতে পারে : পাতলা পায়খানা ও কোষ্ঠকাঠিন্য। কারও আবার দুটোর মিশ্রণ হয়। অধিকাংশ রোগীরই দেখা যায়, কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্য যাচ্ছে, আবার কিছুদিন পাতলা পায়খানা তথা আমাশয় হচ্ছে। তবে কোনটা বেশি হয় তার ওপর ভিত্তি করে আইবিএসকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়- কোষ্ঠকাঠিন্য প্রধান এবং আমাশয় প্রধান। তবে যে সমস্যাটি প্রায় সবার থাকে তা হলো পুনঃপুনঃ পেটে ব্যথা। সাধারণত তলপেটে কামড় দিয়ে ব্যথা হয় এবং পায়খানা হয়ে ব্যথা ভালো হয়ে যায়। পেটে বুট বুট আওয়াজ হতে থাকে। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য প্রধান, তাদের পেটে ব্যথার সঙ্গে ছোট ছোট খন্ডে পায়খানা হয়। আর যাদের আমাশয় প্রধান তাদের ঘন ঘন কিন্তু অল্প পায়খানা হয়। স্বস্থির ব্যাপার হলো, ঘন ঘন পায়খানা হলেও ওজন ঠিক থাকে এবং মলের সঙ্গে শুধু আম যায়, রক্ত যায় না।
আইবিএসের লক্ষণগুলোকে এভাবে সাজানো যায় :
১. মলত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন
২. পেটে কামড় দিয়ে ব্যথা
৩. পেট ফুলে যাওয়া
৪. মলের সঙ্গে আম যাওয়া এবং
৫. মলত্যাগ করার পর ঠিকভাবে ত্যাগ হয়নি মনে হওয়া।
এই সমস্যাগুলো ৬ মাসের বেশি থাকলে এবং মানসিক চাপের সময় এ ধরনের সমস্যা বেশি হলে ডাক্তাররা আইবিএস হয়েছে বলে সন্দেহ করেন। এছাড়া, যাদের এই সমস্যা আছে তারা পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, তেহারি ইত্যাদি তেলযুক্ত খাবার এবং দই, দুধ-চা, পায়েস, সেমাই ইত্যাদি দুধ নির্মিত খাবার খেলে সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় তাদের পেট খারাপ হয়ে পড়ে। আমাদের লিভার সেন্টারের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, যে সব রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহ থাকে এবং ফ্যাটি লিভার থাকে তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো সময় আইবিএসে আক্রান্ত হয়। আবার যে সব রোগী পায়খানার অভ্যাসের পরিবর্তন, পেট ফোলা, পেট ব্যথা বা অস্বস্তি, পেটে শব্দ, সুনির্দিষ্ট কিছু খাদ্য হজম না হওয়া জাতীয় সমস্যা নিয়ে আসে তাদের প্রথম প্রথম আইবিএস হিসেবে সন্দেহ এবং চিকিৎসা করা হলেও পরবর্তীতে এদের লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে।
আইবিএসের চিকিৎসার প্রধান অংশ হলো এ বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়া যে, এটা ক্যানসার জাতীয় কোনো সমস্যা নয়। রোগীদের একটি দল ভয় পেতে থাকে যে, তাদের ক্যানসার হলো কি না। এই উদ্বেগ থেকে তাদের পেট খারাপের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। এ কারণে রোগের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। এছাড়া, যাদের আমাশয় প্রধান আইবিএস তাদেরকে লোপেরামাইড, অ্যামিট্রিপটাইলিন ইত্যাদি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। যাদের পেটে ব্যথা ও বুট বুট আওয়াজের সমস্যা হয় তাদেরকে মেবেভেরিন, অ্যালভেরিন ইত্যাদি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য প্রধান আইবিএস তাদের ফাইবারযুক্ত খাবার (যেমন : শাকসবজি), ইসুপগুলের ভুসি, ল্যাকটুলোজ ইত্যাদি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। যে সব রোগী উপরোক্ত উপায়ে ভালো হয় না তারা অন্যান্য উপায়ে চিকিৎসা নিতে পারেন। এগুলোকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় অল্টারনেটিভ মেডিসিন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো : রিলাক্সেশন থেরাপি, হিপনোথেরাপি, বায়োফিডব্যাক ইত্যাদি। উপযুক্ত চিকিৎসা নিয়ে আইবিএসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে জীবনাচারের মানে অনেক উত্তরণ ঘটে। আবার যেহেতু লিভার সিরোসিস তথা দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের রোগীরা আইবিএসের ন্যায় সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে সেহেতু আইবিএস রোগীদের লিভারের কোনো সমস্যা আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। অতএব, যারা উপরোক্ত সমস্যাগুলো নিজেদের মধ্যে আছে বলে মনে করছেন তাদের উচিত অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা।
ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল
ডিজিজ তথা আইবিডি
দীর্ঘমেয়াদি আমাশয়ের সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো, ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ তথা আইবিডি। আইবিডির মধ্যে দুটো রোগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে : ক্রনস ডিজিজ ও আলসারেটিভ কোলাইটিস। রোগ দুটোতে খাদ্যনালীর আক্রান্ত স্থান, আক্রান্তের ধরন ও প্রকৃতি, খাদ্যনালীর বাইরে সমস্যার উপস্থিতি ও চিকিৎসার ধরনের পার্থক্য আছে। আইবিডি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যা বছরের পর বছর চলতে থাকে এবং হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ও কমে যাওয়ার আচরণ দেখায়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্রনস ডিজিজের চেয়ে আলসারেটিভ কোলাইটিস বেশি হচ্ছে। ওষুধ খেয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখলে আইবিডির রোগীদের আয়ু সাধারণ মানুষের গড় আয়ুর সমানই হয়। লক্ষণীয়, স্বল্পমেয়াদি ব্যাকটেরিয়াজনিত আমাশয়েও রক্ত যায়, কিন্তু এর সঙ্গে আলসারেটিভ কোলাইটিসের পার্থক্য হলো যে, পরেরটি দীর্ঘমেয়াদি। অধিকাংশ রোগীর ওজন ঠিক থাকে। কারও কারও জ্বর, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা ও পেটে অশ্বস্তি লাগার সমস্যা হতে পারে। ক্রনস ডিজিজের মূল সমস্যা হলো আমাশয়, পেটে ব্যথা এবং ওজন কমে যাওয়া। খাওয়ার সঙ্গে ওজন কমে যাওয়ায় রোগী খেতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে ওজন কমে যেতে থাকে এবং ভিটামিনের অভাব থেকে রক্তশূন্যতা, রক্তে তারল্য বৃদ্ধি, স্নায়ুতে সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। কারও কারও পায়খানার সঙ্গে বমি ও মুখে ঘা হতে পারে।
আলসারেটিভ কোলাইটিস ও ক্রনস ডিজিজ উভয় রোগেই অন্ত্রনালীর বাইরে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন : কনজাঙ্কটিভাইটিস, আইরাইটিস ইত্যাদি চোখের সমস্যা, ফ্যাটিলিভার, পিত্তথলীর পাথর ও প্রদাহ, গিড়ায় ব্যথা, চর্মরোগ ইত্যাদি। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি আমাশয়ের, পাশাপাশি এ জাতীয় সমস্যাগুলো থাকলে চিকিৎসকরা আইবিডির ব্যাপারে সন্দেহ করেন।
আইবিডি রোগ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। এর মধ্যে আছে : অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পায়খানার পরীক্ষা ও কালচার স্টাডি, এন্ডোস্কপি, কলোনস্কপি, ব্যারিয়াম এনেমা।
আইবিডি রোগটি যেমন দীর্ঘমেয়াদি এর চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি। আইবিডির চিকিৎসায় দীর্ঘদিন স্টেরওয়েড, স্যালাজিন, মিথোট্রিক্সেট, সাইক্লোস্পরিন, এন্টাই টিএনএফ ইত্যাদি শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। এজন্য এ রোগের চিকিৎসা নিয়মিত চিকিৎসকের সান্নিধ্যে থেকে করতে হয়। তদুপরি যাদের ৮ বছরের বেশি সময় ধরে আইবিডি রোগ থাকে তাদের অন্ত্রে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ কারণে এ রোগের ব্যাপারে অবহেলা করার নূ্যনতম সুযোগ নেই।
পরিশেষে, আমরা এই প্রবন্ধটির মধ্য দিয়ে মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কমন একটি সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারলাম। যেহেতু আমাশয় স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি যে কোনো রকম হতে পারে এবং এদের চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন, সেহেতু আমাদের উচিত এ রোগগুলোর ব্যাপারে নিজেরা সচেতন থাকা এবং আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনদের সচেতন করে চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি যাদের দীর্ঘদিন অথবা ঘন ঘন পেটের অসুখের সমস্যা হয় তাদের লিভারের কোনো সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করে নেওয়া দরকার। কেননা, যদি লিভারে প্রদাহ থাকে এবং তা প্রাথমিক পর্যায়েই নির্ণয় করা যায় তাহলে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করে লিভার সিরোসিস নামক জটিল সমস্যাও প্রতিরোধ করা যেতে পারে।