রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস আজ

দেশে প্রায় ৭০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত

পাঠান সোহাগ
  ০৮ মে ২০২৪, ০০:০০
দেশে প্রায় ৭০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত

১২ বছর বয়সের জান্নাত ও ৮ বছর বয়সের রাব্বি মিয়া। দুইজন সম্পর্কে ভাইবোন। গত দুই বছর আগে একই সঙ্গে শরীর হলুদ ও বুক ফুলে উঠলে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর জানিয়ে দেন তারা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। সেই থেকে প্রতি মাসে দুইজনের জন্য এক ব্যাগ করে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে শরীরে দিতে হয়। এই কষ্টসাধ্য কাজটি করে যাচ্ছেন দুই শিশুর মা সিরাজগঞ্জ উলস্নাপাড়ার মোছা. মনিঝা খাতুন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, 'হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ঘুরে ঘুরে রক্ত সংগ্রহ করতাম। এখনও তাই করছি। এক মাসে রক্ত শরীরে না ঢুকালে ছোট ছেলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হয়। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো পথ আমি পাচ্ছি না। দুই ছেলেমেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি এখন নিঃস্ব।'

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার বাসিন্দা জিশান প্রধানের ছোট ছেলে আট বছরের আরাফ প্রধান। জন্মের ছয় মাস পরেই এ রোগ ধরা পড়ে। সেই থেকে অন্যের রক্ত দিয়ে চলছে তার জীবন। আরাফের বাবা বলেন, প্রথমে এলাকার মানুষজন রক্ত দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এখন এলাকার বাইরে থেকে আমরা রক্ত সংগ্রহ করে ২০ দিন পরপর এক ব্যাগ রক্ত দিচ্ছি। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস কর্মী আসমা বেগমের আট বছরের ছেলে সায়মন ইসলামের। ছয় বছর ধরে অন্যের রক্ত দিয়ে চলছে এ ছোট ছেলের জীবন।

শুধু জান্নাত, রাব্বি, আরফ কিংবা সায়মন নয়, দেশে প্রায় ৭০ হাজার শিশুর অন্যের রক্ত নিয়ে জীবন চলছে। এমনকি প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ৬ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যার প্রায় সাত শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। অর্থাৎ প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ মানুষ এই রোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে দেশে প্রতি ১৪ জনে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছেন। আর ৭০ হাজারের বেশি শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর ৬ হাজার শিশু বিভিন্ন ধরনের থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এমনকি প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষ।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের ন্যায় সারাদেশে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হচ্ছে আজ। এবারের প্রাতিপাদ্য 'প্রতিটি প্রাণের মতায়ন এবং অগ্রগতিকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে সকলের জন্য ন্যায়সংগত ও সহজলভ্য থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা'।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবিএম ইউনুস যায়যায়দিনকে বলেন, থ্যালাসেমিয়া হলো একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এসব রোগী ছোট বয়স থেকেই রক্তস্বল্পতায় ভোগে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তিনি বলেন, দেশে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ে হিমোগেস্নাবিন ইলেক্ট্রোফরেসিস টেস্ট করার জরুরি। এদের থ্যালাসেমিয়া শিশু জন্মের হার কমবে। এ রোগ একবার হলে সারা জীবন তা বহন করে বেড়াতে হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বাবা-মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। ভাইবোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

অধ্যাপক এবিএম ইউনুস বলেন, থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের হয়। মাইনর ও মেজর। মাইনর রোগীকে চিকিৎসা করে সুস্থ করা যায়। মেজর রোগীর রক্ত লাগবেই। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকে। চিকিৎসা না করা হলে এ রোগীরা রক্তশূন্যতায় মারা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া হলে হলে ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত রক্ত ট্রান্সমিশন করা হলে এক সময় অন্য অনেক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

ওই চিকিৎসক আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের যদি অস্থি মজ্জা সংযোজন করা যায়, যদি সফল অস্ত্রোপচার হয় তাহলে এ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়। তখন দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নতুন করে রক্তে হিমোগেস্নাবিন বাড়তে শুরু করে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। খুবই ব্যয়বহুল।

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের কমিউনিকেশন অফিসার মাহাদী হাসান ভূঁইয়া জানান, দেশের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের উদ্বোধন করা হয়েছে। এই হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সর্বাধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিশ্চিত করা হচ্ছে সর্বোচ্চ মান। মানসম্মত ল্যাবরেটরিতে থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তের চাহিদা মেটাতে রয়েছে বস্নাড ব্যাংক। এই বস্নাড ব্যাংকে বছরে ৩ হাজার ৫০০ ব্যাগ রক্ত স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। রক্তবাহিত রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধে আমার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে স্ক্রিনিং টেস্টের জন্য এলাইজা টেস্ট মেথড ব্যবহার করে রোগীদের নিরাপদ রক্ত নিশ্চিত করছি।

দেশব্যাপী আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকা এই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে মঙ্গলবার উদ্বোধন করা হয়েছে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষায়িত থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতাল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসায় দেশের অগ্রজ চিকিৎসক আসগর আলী হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মনজুর মোর্শেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফাউন্ডেশনের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সালমা আফরোজ এবং ফাউন্ডেশনের কনসালটেন্ট ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব ডাক্তার আব্দুর রহিম।

এদিকে, বিশ্বের ন্যায় আজ সারাদেশে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস পালিত হচ্ছে। এ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন একটি বর্ণাঢ্যর্ যালির আয়োজন করেছে।র্ যালিটি সকাল ৮টায় রাজধানীর মালিবাগের হোসাফ টাওয়ার থেকে শুরু হয়ে সিআইডি সদর দপ্তর প্রদক্ষিণ করে আবার হোসাফ টাওয়ারে ফিরে আসবে। এ সময়র্ যালিতে থ্যালাসেমিয়া রোগী ও অভিভাবক, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সুশীল সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে