আজ রোববার মধ্যরাতে শেষ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। জাটকা সংরক্ষণ ও মা-ইলিশ রক্ষায় গত ১৩ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এদিকে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জসহ উপকূলবর্তী জেলাগুলোর জেলেপলস্নীতে এখন বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। সাগরে যাওয়ার আগে জেলেরা সেরে নিচ্ছেন তাদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
শনিবার বাগেরহাটের শরণখোলার রাজৈর মৎস্য আড়তের ট্রলার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে মাছধরার ট্রলারগুলো। পাশেই প্রস্তুতিমূলক কাজ সারছেন জেলেরা। কেউ জাল টানছেন, কেউ ট্রলারে তেল? ওঠাচ্ছেন, কেউ বাজার থেকে খাবারসহ নিত্যপণ্য আনছেন, কেউ আবার সব কাজ শেষে ট্রলার ধোঁয়া-মোছায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ কেউ মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নিয়ে পারিবারিক বাজারে ব্যস্ত রয়েছেন। কারোরই যেন কথা বলার ফুসরত নেই! তবে সবার চোখে-মুখেই হাসির ঝিলিক।
জেলেরা জানান, ৬৫ দিন ও ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কবল এবং ঘূর্ণিঝড়
রেমাল ও ডানার কারণে এ বছর তারা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। এতে লাখ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এখন নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় মাছ ধরে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা করছেন।
জাটকা সংরক্ষণ ও মা-ইলিশ রক্ষায় ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার সময় প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারের অর্থ জোগাতে কেউ কেউ চুরি করে মাছ শিকারে গিয়ে অভিযানে ধরা পড়ে জেল-জরিমানারও শিকার হয়েছেন। তবে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তারা এখন খুশি।
শরণখোলা উপজেলার মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মজিবর তালুকদার বলেন, 'এ বছর ইলিশ আহরণ মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ বেশি থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে না পারায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন জেলেরা সাগরে গিয়ে ইলিশ আহরণ করতে পারলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে উঠতে পারবে।'
শরণখোলা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'অবরোধ চলাকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার সিংহের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, নৌপুলিশ, আনসার ও উপজেলা টাক্সফোর্স কমিটির সদস্যদের নিয়ে নদী ও সাগরে টহল জোরদার করা হয়েছিল। এ ছাড়া অবরোধকালে জেলেদের সরকারি সহায়তাও দেওয়া হয়েছে।'
বরগুনায় জেলেদের প্রস্তুতি
এদিকে, বরগুনার পাথরঘাটার নোয়াখালী থেকে এসেছেন টিপু খানের মালিকানা এফবি সাইফ-৩ ট্রলারের মাঝি কামাল হোসেন। তিনি বলেন, '২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। আমরা মাছ ধরা থেকে বিরত থেকেছি। আমরা আশাবাদী এবার সাগরে মাছ বেশি পাব।'
এফবি আলস্নাহর দান ট্রলারের মাঝি আলী হোসেন ট্রলারে জাল টানছেন আর বলছেন, 'ভাই কথা কওয়ার এহন সময় নাই। জাল টানছি ট্রলারে। এহনো বাজার সদায় করা বাকি আছে। রোববার রাইত ১২টার পর সাগরে রওনা হমু।' ?
জেলে গিয়াসউদ্দিন, আকরাম, আহের উদ্দিন বলেন, 'মাইয়া-পোলারে কইয়া আইছি সাগরে যামু, এহন ট্রলারের কাজ করি, এহনো বাজার সদায়সহ ট্রলারের অন্য কাজ বাকি আছে। বাড়ি যাওয়ার আর সময় পামু না, হেই জন্য বাড়ির সবাইরে কইয়া আইছি।'
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, 'আমাদের প্রায় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। কিছু কাজ? বাকি আছে। আমাদের জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মানছেন, নিষেধাজ্ঞা শেষেই সাগরে? যাবেন তারা।'
উপকূল অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, 'জেলেদের দুঃখ কেউ বোঝে না, বা বোঝার চেষ্টাও করে না। জেলেদের সরকারি সহায়তা অপ্রতুল। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় সহায়তা বিতরণে জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন বিপদে পড়ে।'
তিনি জানান, জেলেদের খাদ্যনিরাপত্তা ও জীবিকায়ন সচল রাখার জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলেদের 'নিহত জেলে পরিবার বা স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেদের আর্থিক সহায়তা নীতিমালা-২০১৯' রয়েছে। এতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত-জলদসু্যদের হামলায় নিহত বা নিখোঁজ নিবন্ধিত জেলের পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা এবং একই ধরনের কারণে স্থায়ীভাবে অক্ষম জেলেকে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সহায়তার বিষয়টি অধিকাংশ জেলেই জানেন না। প্রচার-প্রচারণা নেই। এ ছাড়া আবেদন করেও সহায়তা পাননি অনেকেই। জেলেদের আর্থিক সহায়তা নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন। সহায়তা বাড়ানো দরকার, প্রচার-প্রচারণা, জেলেপলস্নীতে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকসহ প্রাপ্যতা এবং অধিকারের বিষয় সচেতনতা বাড়ানো দরকার। তাহলে মৃত জেলেদের দায়দেনা পরিশোধসহ সঞ্চিত টাকা পরিবারের কাজে আসবে।
পাথরঘাটা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাসিবুল হক বলেন, 'জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মেনেছে। সরকারের বরাদ্দ অনুযায়ী জেলেদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে জেলেদের তুলনায় বরাদ্দ কম। বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।'