বিদু্যৎ খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট চালাতে আওয়ামী লীগ ম্যাজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এই অবস্থায় শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছরের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানিয়েছে দলটি।
বৃহস্পতিবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়েছে। 'গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাট ও পাচার' শীর্ষক বিশ্লেষণ তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষে বক্তব্য দেন সাবেক বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রী ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নজরুল ইসলাম খান।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কে আওয়ামী লীগের যে দুর্বৃত্তায়ন, তাদের যে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট এটা কিন্তু নিচে পড়ে যাচ্ছে। এরা এক ধরনের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এ কথাগুলো আমাদের বারবার বলা দরকার। কারণ এটা না বললে আওয়ামী লীগ যে দুর্বৃত্তায়ন করেছে, সেটা মানুষ ভুলে যাবে। আপনাদের এ বিষয়টি গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, 'আমরা পুরো বিষয়গুলো রিভিউ করব। এগুলো করে যেটা প্রয়োজনীয় সেটা আমরা করব।'
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'আমাদের মনে রাখতে হবে রিভিউ মানে বাতিল না। আমরা দেখবো যে, কোন কোন জায়গায় দূর্বলতা ছিল।'
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার বিদু্যৎ খাতে যে ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছিল, এটা করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পকেট কেটে নিয়ে গেছে। এখানে প্রত্যেকেই বিদু্যৎ বিল পরিশোধ করেন, সবাই ভুক্তভোগী। আসলে তারা এটা (বিদু্যৎ) একটা ব্যবসার খাত বানিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল কোনো হিসাব না দিয়ে- এই খাত থেকে কুইক মানি বানানো যায়। কারণ বিদু্যৎ তো 'হাওয়া', এটি দেখা যায় না।'
তিনি আরও বলেন, 'ক্যাপাসিটি চার্জ- কোন মেশিনে কত ক্যাপাসিটি? কে এটাকে আইডেন্টিফাই করেছে এবং সেই মেশিনগুলো এফিসিয়েন্সি কী এগুলো কেউ বিশ্লেষণ করেও না, দেখেও না। এই ক্যাপাসিটির নামে তারা ১৫ বছরে অনেক টাকা নিয়ে গেছে, প্রায় এক লাখ কোটি টাকা নিয়ে চলে গেছে। আমি অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বলব, আওয়ামী লীগ সরকার বিদু্যৎখাতের প্রতিটি চুক্তি কোনো পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল মেনে করা হয়নি, তারা আইন করে নিয়মনীতি বন্ধ করে দিয়ে ইচ্ছামতো ক্লোজ টেন্ডারে এসব চুক্তি করেছে। এসব পাবলিক হওয়া উচিত। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হলো এসব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করা।'
'বিদু্যখাতের দুর্নীতি-লুটপাট'
সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতির পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'বিদু্যৎখাতে ১৫ বছরে মোট খরচ হলো ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার বর্তমান বিনিময় হারে তা হলো- ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জে লুটপাট হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে হয়েছে ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৮ হাজার ৯শ' কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ এ হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তার অর্থ হলো এই যে, প্রাইভেট সেক্টরে পাওয়া পস্ন্যাটগুলো দিয়েছে সেগুলো চলে নাই এবং এই টাকাগুলো তাদের (কোম্পানি) পেমেন্ট করেছে- এভাবে দেশের মানুষের কাছ থেকে জাস্ট লুট করে দিয়ে গেছে আরকি।'
টুকু আরও বলেন, 'ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগের মেশিনগুলো খারাপ। খারাপ মেসিন এসে টাকা কামাই করে চলে গেছে। আর এই লুটপাটের অংশ কারা কারা ছিল? ক্যাপাসিটি চার্জের শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির কথা আমি বলছি। এরা হল, সামিট নিয়েছে ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, এ্যাগ্ররো ইন্টারন্যাশনাল নিয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, আল্ট্রা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রম্নপ নিয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, আরপিসিএল নিয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। তিনি আরো বলেন, কুইক রেন্টাল পাওয়ার পস্ন্যান্ট আসে সাধারণত আপদকালীন বিদু্যৎ সংকট নিরসনের জন্য। এই পস্ন্যান্ট দ্ইু বছরের সেটা ১৫ বছর পর্যন্ত চালাচ্ছে এবং এসব কুইক রেন্টালে ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে উইথ আউট রিটার্ণ। বিএনপির এই নেতা বলেন, ভারত থেকে বিদু্য আমদানির নামে ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।'
'যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়বে'
সাবেক এই বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রীর দাবি, 'আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদু্যতে যেসব উন্নয়ন করা হয়েছে এই বিদু্যৎ উন্নয়ন টেকসই না, সাসটেইনেবল না। যে কোনো সময়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। বিদু্যৎখাতে দুর্নীতির ধরন দেখার পর বুঝা যায় যে তারা বিদু্যৎ খাতকে ফোকলা করে দিয়েছে কিছু নাই আরকি। একটা উদাহরণ বলি, প্রতি মিটারের জন্য গড়ে অতিরিক্ত খরচ করেছে ৪ হাজার ৫শ' টাকা ক্রয় করেছে ৬ হাজার ২শ' টাকা দিয়ে তাহলে দেখা যায়, অতিরিক্ত একহাজার ৭২০ টাকা প্রতি মিটারে। তাহলে দেখেন কত টাকা নিয়ে বুঝেন তারা এবং এনআইসি কার্ডের দাম ২ হাজার টাকা, তারা ধরেছে ৫ হাজার ২১৫ টাকা এভাবে দেখবেন, এই খাতের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি। কোনো দুর্নীতির শেষ নাই।'
'রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি'
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'রূপপুরে পারমানবিক প্রকল্পের ৫শ' বিলিয়ন ডলার তারা (শেখ হাসিনাসহ তার পরিবার) নিয়ে গেছে, সেটা নিয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে লন্ডনে টিউলিপের (ব্রিটিশ সংসদ সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকী- শেখ রেহানার মেয়ে) ব্যাপারে এবং আরও দুর্নীতি আছে আরকি।'
'প্রিপেইড মিটার বাণিজ্যে সিন্ডিকেট'
সাবেক বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'এটা তাদের (শেখ হাসিনাসহ তার পরিবার) একটা সিন্ডিকেট। ৭১ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের কাছে তারা মিটার পৌঁছাবে এবং সেখানে বিরাট অংকের একটা দুর্নীতি প্রায় ৩৬ কোটি টাকা পাচার করেছে ১ হাজার ২৩৫ কোটি অতিরিক্ত খরচ করেছে। এর মধ্যে দুর্নীতি করেছে ৬১৭ কোটি টাকা। মিটার সরবরাহ ও স্থাপন বাস্তবায়নে ছিল ৪ হাজার ৫শ' কোটি টাকা, সেটা ১২ হাজার কোটি টাকা করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'স্মার্ট প্রিডেইড মিটার প্রকল্প- এটার যে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, এই নেটওয়ার্কটা হচ্ছে কিছু ব্যক্তির নেটওয়ার্ক। যেখানে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়রা আছে, তাতে তারা কোটি কোটি টাকা লাভবান হবে।'
এলএনজি প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা সাবেক বিদু্যৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কোম্পানিসহ 'একটি চক্র' লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ করেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুক।