চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশে শীতের বিস্তার বেড়েছে। নতুন বছরের শুরুতেই শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড় ও দিনাজপুরের জনপদ কাঁপছে শীতের দাপটে। এছাড়া প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকছে। কুয়াশাময় এই পরিস্থিতি আরও দুই থেকে তিনদিন অব্যাহত থাকবে এবং কুয়াশা কেটে গেলেই শৈত্যপ্রবাহ হানা দেবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে, গত দুদিন ধরে রাজধানীর আকাশে সূর্যের দেখা মেলেনি। বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার তাপমাত্রার পারদ কমেছে ২ ডিগ্রি। পাশাপাশি বেড়েছে বাতাসের প্রবাহ। আর এতেই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, তাপমাত্রা আরও সামান্য কমতে পারে।
বৃহস্পতিবার আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, 'এরকম কুয়াশা আরও দুই-তিন দিন থাকবে। এই সময়ে ঠান্ডা এখনকার মতোই থাকবে। এরপর কুয়াশা কেটে গেলে রাতের তাপমাত্রা ক্রমশ কমে শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে।'
তিনি বলেন, 'জানুয়ারির ৬ থেকে ৭ তারিখের পর রাতের তাপমাত্রা কমে ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসতে পারে। চলতি জানুয়ারিতে একটি থেকে তিনটি মৃদু থেকে মাঝারি এবং একটি থেকে দুটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।'
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও আশপাশের এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, এর বর্ধিতাংশ উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ বলেন, 'রাজধানীর তাপমাত্রা অন্য এলাকার তুলনায় বেশি হলেও হিমেল বাতাসের কারণে শীতের অনুভূতি বেশি হচ্ছে। এই তাপমাত্রা আর সামান্য পরিমাণ কমতে পারে। এদিকে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা আরও কিছুটা কমে যেতে পারে।'
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, বছরের শুরু থেকেই শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে এ জেলা। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
রাকিবুল হাসান আরও জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় জেলার ওপর দিয়ে দ্বিতীয় দফায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, যা দুই একদিন অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪-৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মেঘের উপস্থিতি থাকতে পারে। সেজন্য তাপমাত্রা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে, গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৮৭ শতাংশ। যা চলতি মৌসুমে জেলায় এবং সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল।
তিনি বলেন, 'জেলায় গত ১৫ দিন ধরে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও, নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন থেকেই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষজনের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।'
চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রাণকেন্দ্র বড়বাজার চৌরাস্তার মোড়ে কাজের সন্ধানে আসা মানিক নামের এক শ্রমিক বলেন, 'বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে খুব ঠান্ডা পড়ছে। ভোরে কাজের সন্ধানে বের হয়েছি। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। এমন হলে কাজ করা সম্ভব নয়।'
আরেক শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, 'একদিন কাজে না এলে বাড়ির চুলায় আগুন জ্বলবে না। বাধ্য হয়েই এই তীব্র শীতের ভোরে কাজে আসতে হচ্ছে।'
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ঠান্ডা বাতাস ও কুয়াশার কারণে সকাল থেকে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা দেখা গেছে। শিশু ও বয়স্করা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনে ধীরগতি
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিলস্না জানান, ঘন কুয়াশার কারণে বেলা বাড়লেও সূর্যের দেখা মেলেনি। ঘন কুয়াশায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করছে। দুর্ঘটনা এড়াতে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন চালকেরা।
আবহাওয়া অফিস বলছে, আরও তিন থেকে চার দিন এ অবস্থা থাকতে পারে। আর দুর্ঘটনা রোধে চালকদের সাবধানে গাড়ি চালানোর পরামর্শ দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা পড়েছে কুমিলস্না জেলায়। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় মহাসড়কের কুমিলস্না সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘন কুয়াশার কারণে কমে গেছে দৃষ্টিসীমা। হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। মহাসড়কে কুমিলস্না আদর্শ সদর উপজেলার আলেখারচর, কুমিলস্না সদর দক্ষিণের সুয়াগাজী এবং চৌদ্দগ্রামের কয়েকটি অংশে গিয়েও একই দৃশ্য দেখা যায়।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি বাসের চালক আবদুস সালাম বলেন, 'এবারের শীত মৌসুমে এমন কুয়াশা আর দেখা যায়নি। পুরো মহাসড়কে একই অবস্থা। কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ১০ থেকে ১৫ হাত সামনে দেখতেও কষ্ট হচ্ছে। এ কারণে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছেন।'
বেলতলী এলাকায় মোটরসাইকেল চালক মো. মহিউদ্দিন বলেন, 'যেমন কুয়াশা, তেমনই তীব্র ঠান্ডা। এমন অবস্থা এই মৌসুমে প্রথম দেখলাম। ভারী শীতের কাপড় পরেও ঠান্ডার কারণে মোটরসাইকেল চালাতে কষ্ট হচ্ছে। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।'
হাইওয়ে পুলিশ, কুমিলস্না অঞ্চলের পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি খায়রুল আলম বলেন, 'ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কিছুটা ধীরগতিতে যান চলাচল করছে। দৃষ্টিসীমা কমে যাওয়ায় কারণে দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন চালকেরা। মহাসড়কে ঘন কুয়াশা থাকলে দুর্ঘটনা ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ জন্য হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা মহাসড়কে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছেন। গতির চিন্তা না করে সাবধানে গাড়ি চালানোর জন্য চালকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।'
রাজধানীতে বেড়েছে শীতের প্রকোপ
এদিকে, দুদিন ধরে রাজধানীর আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে তাপমাত্রা কমেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হিমেল বাতাসের সঙ্গে তাপমাত্রা কমায় শীতের প্রকোপ বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা আরও সামান্য কমতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও আশপাশের এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, এর বর্ধিতাংশ উত্তরপূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
সংস্থাটির দেওয়া তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা আগের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি। একইভাবে ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৮, যা আগেরদিন ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীতে আগের দিন ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গত ২৪ ঘণ্টায় তা ২ ডিগ্রি কমে ১০ দশমিক ৫ সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে রংপুরে আগের দিনের তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ সেলসিয়াস গত ২৪ ঘণ্টায়ও অপরিবর্তিত ছিল, আর ময়মনসিংহে দুই ডিগ্রি কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সিলেটের তাপমাত্রা ১৬ দশমিক ২ সেলসিয়াসে অপরিবর্তিত ছিল।
এদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তাপমাত্রা কিছুটা কমে ১৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে কমে ১৫ দশমিক ৭ সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। খুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি কমে ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে, যা আগের সময়ে ছিল ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বরিশালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগের একই সময়ে প্রায় একই রকম ১৪ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।