রমজান ঘিরে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্যের জট এখন চট্টগ্রাম বন্দরে। স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে মজুত করা যায়, বর্তমানে তার চেয়ে ৮ হাজার বেশি পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ রয়েছে বন্দরে। অভিযোগ উঠেছে, পণ্য খালাস না করে মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাই আগামী ৯ মার্চের মধ্যে এসব পণ্য না নিলে ৪ গুণ মাশুল আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তবে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। একটি অংশ বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্কেল বসানোর কারণে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না। যে কারণে সড়কে না রেখে নিরাপত্তার খাতিরে জাহাজেই রাখা হচ্ছে এসব পণ্য। আর অন্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪ দিনের ফ্রি রেন্ট সুযোগ দিলেও এই সময়ের মধ্যে পণ্য খালাসে কাস্টমসের কারণে ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের। ফলে জনবল বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন ভোগ্যপণ্য নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে ও বাজার ব্যবস্থাপনাকে সুন্দর করতে এমন সিদ্ধান্ত কাজে আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা যে কোনো পণ্যবোঝাই কনটেইনার চার দিন পর্যন্ত বিনা শুল্কে বন্দরের ইয়ার্ডে রাখার সুযোগ পান আমদানিকারকরা। বাড়তি সময়ের জন্য ২০ ফুট আকৃতির কনটেইনার ৬ ডলার, ৪০ ফুটের কনটেইনারের জন্য ১২ ডলার জরিমানা দিতে হয়। এভাবে প্রতিটি কনটেইনার থেকে ২৪ এবং ৪৮ ডলার পর্যন্ত জরিমানা আদায় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে বর্তমানে মজুত ৩৮ হাজার কনটেইনারের মধ্যে ৩১ হাজার ৩৮৪টি এফসিএল (ফুল লোড) কনটেইনার। আমদানি করা এসব কনটেইনারের পণ্য ছাড় না করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বন্দরের ইয়ার্ডে ফেলে রেখেছে। অভিযোগ উঠেছে, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই এসব কনটেইনার ছাড় করানো হচ্ছে না।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসান উলস্নাহ জাহেদী জানান, অতিরিক্ত পণ্য আসার কারণে খালাসের ক্ষেত্রে একটু সময় লাগছে। যার কারণে মালগুলো সেখানে পড়ে আছে।
এদিকে, গত সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দর নানা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল বলে অভিযোগ করেছেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, এ সিন্ডিকেট ভাঙতে আমরা সফল হয়েছি। বন্দরের খরচ উলেস্নখযোগ্য হারে কমেছে। লাইটারকে আর ভাসমান গুদাম বানিয়ে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া হবে না। পণ্য আসার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খালাস করতে হবে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, 'রমজানে পণ্যের যেই চাহিদা থাকে সারা দেশে, তার ৬০ শতাংশ এরই মধ্যে খাতুনগঞ্জ থেকে বিক্রি হয়েছে। বাকি ৪০ শতংশ পণ্যের চাহিদা হবে ১৫ রমজানের পর। বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড কিংবা বহির্নোঙরে পণ্য মজুত করার যেই বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তার মূল ঘটনা আসলে ভিন্ন। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারকে বলে আসছি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে যেই পরিমাণে পণ্য পরিবহন করা হতো, বর্তমানে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বারিয়ারহাট ও কুমিলস্নার দাউদকান্দি এলাকায় স্কেল বসানোর কারণে তা যেতে পারছে না। স্কেল দিয়ে ১৩ টন পর্যন্ত মালপত্র পরিবহন করা যায়। কিন্তু পুরো বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৫ টন পর্যন্ত মাল যাচ্ছে। ফলে বড় ব্যবসায়ী কিংবা আমদানিকারকরা জাহাজ অথবা লাইটার জাহাজে পণ্যগুলো রাখেন। কারণ সড়কে এতগুলো পণ্য ফেলে রাখা যায় না। লাইটার জাহাজে পণ্য রাখা তাদের কাছে নিরাপদ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্কেল বসানোর ব্যবস্থা না থাকলে সেখানে (বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড কিংবা বহির্নোঙর) কেউ পণ্য মজুতও করত না।'
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব মো. রুহুল আমিন সিকদার বলেন, 'চট্টগ্রামের ১৯টি অফডকে সোমবার পর্যন্ত রপ্তানির পণ্যবাহী কনটেইনার রয়েছে প্রায় আট হাজার ৯৫০ টিইউস। আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার রয়েছে ৯ হাজার ৩০০ টিইউস। আর খালি কনটেইনার রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টিইউস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে আরও ১৫ শতাংশ বেশি। রমজান মাসে পণ্যের আমদানি বাড়ায় কনটেইনারও বেড়েছে। আর রমজান মাসে পণ্য জমা করে খালাস না করার কোনো বিষয় আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা যেসব কনটেইনারে পণ্য আনি, সেগুলো যত দ্রম্নত সম্ভব খালাস করতে পারলেই ভালো। ব্যবসায়ীরাও তা চান।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহায়ক কমিটির সদস্য ও ক্লিফটন গ্রম্নপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু এর উল্টো পিঠে আরেকটি বিষয় রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের বলছে, তারা যেন দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস করেন। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে
ব্যবসায়ীদের। কারণ জনবলের দোহাই দিয়ে রমজানে কর্মঘণ্টা কমাতে পারেন তারা। আগে যেই পরিমাণে লোকবল ও সময় তারা দিতেন, এখন সেটাও পাওয়া না যেতে পারে। তাই এ বিষয়টিকে নিশ্চিত করার আহ্বান থাকবে।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ৩৮ হাজার কনটেইনার রয়েছে। এগুলোর সবই ইমপোর্ট কার্গো। প্রতিটি পণ্যের ফ্রি রেন্ট (বিনা শুল্ক) থাকে চার দিন পর্যন্ত। আমরা চাই, যারা মালপত্র খালাস করবে, তারা যেন আমাদের ফ্রি সময়ের মধ্যে নিয়ে যায়। তাহলে তাদের কোনো শুল্ক পরিশোধ করতে হবে না। যেই মালগুলো রেখে যাবে, সেগুলো যেন কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে রাখতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই চার গুণ হারে মাশুল নির্ধারণ করতে আইনে আমাদের প্রভিশন আছে। মূলত ব্যবসায়ীরা পণ্য খালাস করছেন না বলেই এসব পণ্য জমা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বন্দরে ৩০ থেকে ৩২ হাজার পর্যন্ত কনটেইনার জমা থাকলে আমরা সেটাকে সহনীয় পর্যায় বলে থাকি। অর্থাৎ বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ হাজার কনটেইনার বেশি রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যখন দেখবে, ব্যবসায়ীরা দ্রম্নত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস করছেন, কনটেইনার বন্দরে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে তখন মাশুল গোনার এই হার প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এটা মাঝে মাঝে দিতে হয়, যাতে অসৎ উদ্দেশ্যে কেউ মালপত্র ফেলে রেখে না যান।'