রাত সাড়ে ১০টার দিকে মায়ের চেঁচামেচিতে আমরা ভাইবোনরা ভয় পেয়ে গেলাম। শ্যামা তার ক্লাসের বই ফেলে এক দৌড়ে সোজা মায়ের ঘরে। আমি আর রোজী আপা ঝড়ের বেগে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখি বাবা অজ্ঞান হয়ে খাটে লুটিয়ে পড়ে আছেন। মা পাগলের মতো উচ্চস্বরে বাবাকে ডাকছেন- 'ও রোজীর বাপ, কি হইছে আপনার? চোখ মেলেন না কেন?' রোজী আপার কাঁদো কাঁদো দশা। বাবার গায়ে হাত দিয়ে দেখি তার সমস্ত শরীর ঠান্ডায় হিম হয়ে গেছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মাসুদ ভায়ের ফোনে কল দিয়ে দেখি নাম্বার ব্যস্ত। শেষে নিজেই বাজারে গিয়ে ডাক্তার নুরুল আমিনকে নিয়ে এলাম। বাবাকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি যেটা আবিষ্কার করলেন- সেটা হলো বাবা পরপর তিনবার প্রেসারের ওষুধ খেয়েছেন। পরে শিরায় ওরাডেক্সিন ইনজেকশন মেরে বাবাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হলো।
এই যে পরপর তিনবার ওষুধ খেয়ে ফেলা- এটা ইচ্ছাকৃত না। বয়স বাড়ার কারণে বাবার স্মৃতিশক্তি ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাত দুপুরে ঘুম ভাঙলে তার নাকি মনে হয় তিনি দুয়ারের সিটকানি আটকাননি। নামাজ পড়েও দ্বিতীয়বার আবার নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যান। এটা বয়সের খেলা। তারপর আগোছালো সংসারের টানাপোড়ন আর বড় ছেলে মাসুদের নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে বাবার এই 'ভুল হয়ে যাওয়া' রোগটা স্বগৌরবে হানা দিয়ে ওঠে। শুধু বাবা না, আমাদের বাকি চার সদস্যও মাসুদ ভায়ের এই বখে যাওয়া নিয়ে সমান চিন্তিত।
মধ্যরাত অব্দি বাবাকে সেবা প্রদান করতে গিয়ে আমরা ঘরের চারজন সদস্য যখন হাঁপিয়ে উঠছি, তখনই প্রতিদিনকার মতো মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে উপস্থিত হওয়া মাসুদ ভাইকে দেখে রোজি আপা রাগী গলায় বলল- 'তোর কি সংসারের দিকে খেয়াল আছে? বাবা যে আজ মরতে মরতে বেঁচে গেল তুই জানিস?' আপার কথায় মাসুদ ভায়ের যতটুকু গলে যাওয়ার কথা, ততটা তো গেলই না, বরং অসভ্যের মতো গর্জে উঠে, 'মরলো না ক্যান?' এই ঘরের বড় ছেলের এমন অপ্রত্যাশিত কথায় আমরা বাকি তিন ভাইবোন যখন একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি, তখনই মা'র কণ্ঠে কান্নার রোল তোলে উল্কার মতো উড়ে গিয়ে মাসুদ ভায়ের গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর আমরা অবাক হয়ে যে দৃশ্যটা দেখলাম, সে দৃশ্যটা হলো- মাসুদ ভাই মা'কে স্বজোরে ধাক্কা দিলেন এবং মা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। এরকম দৃশ্য আজকাল আমাদের ঘরে প্রায়ই দেখা যায়। শ্যামা ফিসফিস করে আপাকে বলল, আপা, বাবা কাঁদছে, দেখ।
চার বিষয়ে লেটার পাওয়া ছেলের এমন বখে যাওয়া মানতে পারছেন না আমার বাবা-মা। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তাদের প্রিয় ছেলে মাসুদ বদলে যেতে থাকে। কলম ফেলে সিগারেট হাতে নেয়। গুরুজনকে সালামের বদলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে। রোজ তার বিরুদ্ধে বাড়িতে আসতে থাকে নানান অভিযোগ। সুশীল সমাজে লজ্জায় মাথা কাটা পড়ে বাবার। শ্যামা একদিন আবিষ্কার করে মাসুদ ভায়ের তোষকের নিচে পাতায় পাতায় ঘুমের বড়ি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক ভর দুপুরে বাবা আর মাসুদ ভায়ের হাতাহাতির পরপরই ছোট খাটো একটা স্ট্রোক হয় বাবার। একদিন আলমারি থেকে গায়েব হয় মাকে দেয়া দাদির শেষ উপহার সোনার চেইনটি। সকাল সন্ধ্যা বিলাপ করে কাঁদলেন মা আর রোজী আপা। আমি জানি, এই চেইন চোর কে? এত কিছুর পরও ভায়ের পরিচয়ে তার সঙ্গে আমার রক্তের একটা বন্ধন থাকে। রাতে তার সঙ্গে একই খাটে ঘুমাইও।
২.
দুলাভাইয়ের পাঠানো তালাক নামায় সই করার পর রোজী আপা বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদলেন। মা কাঁদলো, শ্যামা কাঁদলো, বাবা চোখ মুছতে মুছতে ডালিম তলায় গিয়ে বসলেন। আমি আহত চোখে এই বাড়ির সব মানুষের শোক মাখানো একটা চিত্র দেখলাম। প্রিয় রোজী আপার ভালোবাসার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টিকলো না দেখেও কেন যেন খারাপ লাগেনি আমার।
মনির ভাইকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে আমার রোজী আপা। অনেক কেলেংকারীর পর আপাকে শ্বশুর বাড়ির লোকরা ঘরে তুলল। সংসারি হওয়ার পরপরই আপা বুঝতে পারল তার স্বপ্নের পুরুষটি চরিত্রহীন। মেয়েদের সঙ্গে তার গোপনে খারাপ সম্পর্ক। এসব মেনে নিতে না পেরে আপা চলে এলো বাবার বাড়ি। তারপর উভয় পরিবারের অনেক ঝড়ঝাপটার অবসান হলো তালাকে।
এক সকালে পালপাড়া থেকে রাজুর মামা এসে আমাদের যে খবরটি শোনালেন, সেটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। রাজুর সঙ্গে আমাদের শ্যামার বিয়েটা নাকি হবে না। অথচ রাজু-শ্যামার আংটি বদলও হয়েছে।
বিয়েটা না হওয়ার কারণ হচ্ছে রাজুর বাবা নাকি কার কাছে শুনেছে আমাদের রোজী আপা তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে ব্যাপক নির্যাতনের কারণে মনির ভাই নাকি আপাকে তালাক দিয়েছে! ঠিক একই ব্যাপার যদি শ্যামার বেলায়ও ঘটে, তাই আগে থেকে তারা সতর্ক সংকেত দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিলেন। এই ঘটনায় শ্যামার যতখানি ভেঙে পড়ার কথা, তাকে ঠিক ততটা ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি। আগের মতো সে কলেজে যাচ্ছে। হারমোনিয়ামে বসে গান গাইছে। বাবার সঙ্গে লুডু খেলছে। সে খেলায় বারবার শ্যামার কাছে বাবা হেরে যান। তখন শ্যামা হো হো করে হেসে ওঠে। আমি মুগ্ধ হয়ে শ্যামার সুন্দর হাসি দেখি। এই মেয়ের হাসিতে দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
দিনদিন রোজী আপা এই সংসারে অবহেলিত হয়ে ওঠে। মনির ভাইকে ভালোবেসে বিয়ে করা, বিয়ে বিসর্জন নিয়ে মা যতখানি আপার ওপর রাগ করেছেন, সেই রাগ দ্বিগুণ হয়ে গেল শ্যামার বিয়েটা ভেঙে যাওয়াতে। প্রায়ই মা মেয়ের ঝাগড়া হয়। অপবাদের সুরে মা বলেন, তোর কারণে শ্যামুর বিয়ে ভাঙছে, মরতে পারিস না? একদিন শ্যামা মাকে ধমকের সুরে বলল- 'আপনি আর আপাকে এসব বলবেন না তো! রাজুকে আমার পছন্দ না। বিয়ে না হওয়াতে আমি খুশি!' আমি দূর থেকে শ্যামার কথা শুনে বুঝে গেলাম। তাহলে বিয়ে ভাঙার পরও শ্যামা স্বাভাবিক ছিল এই কারণে?
৩. আমার বন্ধু মজিদের কাছ থেকে চিত্রার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথাটা শোনে আমার ভেতরটা এত দুমড়ে মুছড়ে গেল কেন? চিত্রাকে ভালোবাসি বলে?
আমার জীবনেও নারী এসেছে। তার নাম চিত্রা। প্রফেসরের মেয়ে। আশ্চর্য রূপসী। যতটা আগ্রহ নিয়ে চিত্রাকে মনের কথা জানালাম, ঠিক ততটা হতাশা নিয়ে তার কাছ থেকে ফিরেও এলাম। মুখে না বললেও চিত্রার হাবভাব থেকে ধরে নিলাম। যে কজন যুবককে সে ফিরিয়ে দিয়েছে, আমিও তাদের একজন। তাই চিত্রা নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখার জোড়া চোখ সেখানেই বন্ধ হলো। 'সবাই জীবনে সব পায় না'- এমন সান্ত্বনায় নিজেকে মানিয়ে রাখলাম। তবু আমার বেহায়া চোখ আমাকেই ফাঁকি দিয়ে এক গোপন কল্পনার অভিসারে মেতে ওঠে। সেখানে চিত্রা কেবল আমার একজন স্বপ্ন প্রেয়সী হয়ে উঠে আর আমি হয়ে উঠি একজন নতুন মজনু।
আরো অবাক হলাম- যখন শুনলাম চিত্রার বিয়ে হচ্ছে পালপাড়ার রাজুর সঙ্গে। যার সঙ্গে আমাদের শ্যামার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। পৃথিবী এত অদ্ভুত কেন?