নারী সমাজ জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজের ভূমিকা কোন অংশে কম নয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় সাতশ' কোটি লোকের অর্ধেক নারী। সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। সন্তান প্রতিপালন, সন্তানের জীবন গঠন নারীর প্রথম ও প্রধান কাজ হলেও জীবনের অনেক ক্ষেত্রে নারীর করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। অতীতের মতো নারীসমাজ আর পিছিয়ে নেই। যুগের বির্বতনে তাদের জীবন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবনের গতি ও বেড়েছে কাজ।
বাংলাদেশে ৮৬ হাজারেরও অধিক গ্রাম রয়েছে। দেশের ৮০ ভাগ জনগণই গ্রামে বসবাস করে। পনেরো কোটি জনগণের অর্ধেক নারী। আবার এ অর্ধেক নারীর সিংহ ভাগই বসবাস করে গ্রামে। গ্রাম বলতে চোখের সামনে চিরাচরিতভাবে যেটা ফুটে ওঠে সেটা
হচ্ছে অজপাড়াগাঁ। যেখানে বিদু্যৎ সুবিধা নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গরুর গাড়ি, নৌকা ইত্যাদি- তবে বর্তমানে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে বললে হয়ত ভুল হবে না। কিন্তু বাস্তবে বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ অবস্থা ভিন্ন। গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। যার সিংহভাগ অবদান নারীর। গ্রামীণ নারীরা এখনো উচ্চশিক্ষা বা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাবঞ্চিত এই নারীরা কুটির শিল্প,বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, সেলাই প্রভৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামীণ নারীরা সংসারের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পরও বাড়তি আয় উপার্জনের জন্য, আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ মেটানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের কাজ করে থাকে।
বাঁশ ও বেতের কাজ : গ্রামীণ অর্থনীতির উপার্জনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বাঁশ ও বেতের কাজ। গ্রামীণ মহিলারা বেতের সাহায্যে পাটি, জায়নামাজ, ঝুড়ি ইত্যাদি তৈরি করে থাকে। বাঁশের সাহায্যে মুরগির খোপরি, ঘরের বেড়া ইত্যাদি তৈরি করে- যা স্থানীয় বাজারে ও পাড়া প্রতিবেশীর কাছে বিক্রি করে আর্থিক প্রয়োজন মেটায়।
পোলট্রি শিল্প: গ্রামীণ নারীরা ছোটা আকারে পোলট্রি শিল্পের কাজ করে থাকে। দেশি ও বিদেশি জাতের স্বল্পসংখ্যক মুরগি লালনপালন করে তারা। বিভিন্ন মুরগি ও মুরগির ডিম বিক্রি করে তারা টাকা আয় করে। পোলট্রিশিল্পের বিকাশের ফলে উদ্ভিজ্জ আমিষের প্রয়োজন মিটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে- যা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মৃৎ শিল্প: প্রাচীনকাল থেকে অর্থনীতিক ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদানকারী শিল্প হলো মৃৎশিল্প। শুধু মৃৎশিল্পের ওপর নির্ভর করে অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। মৃৎশিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। মাটি পোড়ানো, কাঠামো তৈরি, নকশা করা, রোদে শুকানো ইত্যাদি সব কাজই নারী তার সুনিপুণ হাতে করে থাকে।
শাকসবজি চাষ : বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ভূমিহীন। চাষাবাদের নিজস্ব জমি নেই। কৃষানিরা বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন শাকসবজি, তরিতরকারির এবং দেশীয় বিভিন্ন ফলমূলের চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির অভাব পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
মৎস্য চাষ : নারীরা শাকসবজির পাশাপাশি মৎস্য চাষও করে। মৎস্য চাষ ছোট হলেও অনেক সাফল্য ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। পুকুুরে তিন মাসের মধ্যে বড় হয় এরকম মাছের চাষ করে, পারিবারিক চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।
গবাদি পশু পালন:গবাদি পশু পালন গ্রামীণ অর্থনীতিতে উলেস্নখযোগ্য একটি কাজ। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যাদের দুই/চারটি গরু-ছাগল থাকে না। গরু দিয়ে চাষাবাদের পাশাপাশি দুধ ও গরুর বাছুর বিক্রির মাধ্যমে সংসারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা হয়। বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতীয় ছাগল পালন অত্যন্ত লাভ জনক বলে বিবেচিত। কারণ এ জাতীয় ছাগল বছরে একাধিক বাচ্চা দেয়। যার ফলে, নারীরা পারিবারিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে।
সূচিকর্ম :প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি নারীরা স্বভাব বসতভাবে যে কাজটা করে তা হলো সূচিকর্ম। নারীরা ঘরে বসে অবসর সময়ে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নকশি কাঁথা, তোশক ইত্যাদি তৈরি করে। নকশি কাঁথার মধ্যে নারীরা বিভিন্ন ফুল, পাতা, পাখি, পহেলা বৈশাখ, বিভিন্ন উৎসব, গ্রামীণ নারী জীবনের সুখ-দুঃখ ইত্যাদি কারুকার্য ফুটিয়ে তোলে সূচিকর্মের মাধ্যমে। নারীদের এই সূচিকর্ম বর্তমানে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া, নারীদের হাতের বিভিন্ন কারুকার্য দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা জাগাতে সক্ষম হয়েছে।
গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের এই অবদান অর্থনৈতিক উন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও এর কোনো স্বীকৃতি নেই, নেই কোনো সরকারি পৃষ্টপোষকতা। নারীদের এই অর্থনৈতিক সংগ্রাম অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে হয়ে থাকে। যার পেছনে রয়েছে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচকতা, পারিবারিক অসহযোগিতা, নারীদের বন্দিদশা সবকিছু মিলিয়ে বেশ কঠিন।
১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি.'র এই দেশে তাদের এই অর্থনৈতিক সংগ্রাম সমুদ্রে ঢিল ছোড়ার মতো। এই অর্থনৈতিক পশ্চাদপতার মূল কারণ সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব।
কহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কারণে শহরের নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হলেও গ্রামীণ নারীরা থেকে যাচ্ছে পিছিয়ে।
একটা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পূর্বশর্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন করা। যার অধিকাংশই পূরণ হবেগ্রামীণ নারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত মূলধন, সার্বিক সহযোগিতা, সহজশর্তে ঋণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, ঋণের সুদ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে। সঠিক তদারকির মাধ্যমে গ্রামের প্রতিটি ঘরের নারীদের যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যায়, তাহলে পুরো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।