শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২

প্রতিভাময়ী নারী কুসুমকুমারী

ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন কুসুমকুমারী। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য যে চিত্রশোভিত বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যাংশ ছিল।
নন্দিনী ডেস্ক
  ১১ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
প্রতিভাময়ী নারী কুসুমকুমারী
প্রতিভাময়ী নারী কুসুমকুমারী

নারীরা সমাজে অসংখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিভিন্নভাবে তার অবদান রেখেছেন। এক সময় নারীরা তাদের ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন, সংসার পরিচালনা করতেন এবং সন্তান লালনপালন করতেন। প্রাচীন যুগে একজন মেয়েকে কাঠখড় পুড়িয়ে নিজেকে তৈরি করতে হতো। পরিবার সহায় হলে সে মেয়ে অনেক দূর এগোতে পারতেন। তবু কোথাও গিয়ে থেমে যেতে হতো পারিবারিক, পারিপার্শ্বিকতার চাপে পড়ে।

তবে এত কিছুর মাঝেও কিছু কিছু নারী নিজেদের সব প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে বের করে এনেছে।

এমনই একজনর হলেন কুসুমকুমারী দাশ। তিনি কবি জীবনানন্দ দাশের মা। তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন।

'আদর্শ ছেলে' তার বিখ্যাত পদ্য, যা বাংলার ঘরে ঘরে পড়া হয়। এখনো সন্তানদের উদ্দীপ্ত করার জন্য এই কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। তার প্রথম চরণ 'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।' কুসুমকুমারী দাশের কালজয়ী কবিতাটি এখনো পাঠকসমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

কবি জীবনানন্দ দাশের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা'র শেষে যে জীবনকথা রয়েছে, তাতে বলা হয়েছে জীবনানন্দ দাশ তার মায়ের কাছ থেকে কবিতা ও প্রকৃতিপ্রীতি লাভ করেছিলেন। তিনি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকেই।

কুসুমকুমারী দাশ ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর এক বিদ্যানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চন্দ্রনাথ দাশ এবং মাতা ধনমাণি। চন্দ্রনাথ দাশ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় গ্রামবাসীদের বিরোধিতায় গৈলা গ্রামের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে বরিশালে চলে আসতে বাধ্য হন।

কুসুমকুমারী একটি পারিবারিক পরিমন্ডল পেয়েছিলেন। বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের হাইস্কুলে তিনি ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল ছাত্রীর অভাবে। কুসুমকুমারীকে তার বাবা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের গৃহে রেখে বেথুন স্কুলে ভর্তি করান। এক বছর পর ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিংয়ে লাবণ্যপ্রভা বসুর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেন।

প্রবেশিকা পড়ার সময়েই ১৮৯৪ সালে তার বিয়ে হয় বরিশালের ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ দাশের সঙ্গে। স্বামীর অনুপ্রেরণায় কুসুমকুমারী সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। বিভিন্ন পত্রিকায় তার কবিতা প্রায়ই প্রকাশিত হতো। এছাড়া, তার স্বদেশি যুগের কবিতা, দেশ বিভাগের ফলে আর্ত জনগণের দুর্দশার কাহিনিসংবলিত কবিতা, সাময়িক ঘটনা নিয়ে অনেক লেখা উলেস্নখযোগ্য।

এই কবির তিন সন্তান- জীবনানন্দ দাশ, অশোকানন্দ দাশ, সুচরিতা দাশ। জ্যেষ্ঠপুত্র জীবনানন্দ দাশ বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এবং জনপ্রিয় কবি। কুসুমকুমারী দাশ শুধু যে একজন কবি ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পেশায় গৃহিণী হয়েও নিপুণভাবে গৃহকর্ম সম্পন্ন করার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করতেন। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও নানারকম সমাজ সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের যে শতবার্ষিকী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে তিনি বরিশালের মহিলাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এবং বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বরিশালের 'ব্রহ্মবাদী পত্রিকা'য় নিয়মিত লিখেছেন।

বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের সভা-উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। তিনি ১৩১৯ থেকে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই, বরিশাল ছাত্র সংঘের সপ্তাহকালব্যাপী মাঘোৎসবের মহিলা দিবসের উপাসনায় আচার্যের কাজ করেছেন। তিনি বরিশাল মহিলা সভার সম্পাদক ছিলেন। বরিশাল অঞ্চলের মহিলাদের স্বাবলম্বী হতে এবং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন।

ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন কুসুমকুমারী। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শিশুদের জন্য যে চিত্রশোভিত বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যাংশ ছিল। তিনি সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে লিখেছেন 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায়। তার অল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে 'প্রবাসী' ও 'মুকুল' পত্রিকায়। সে সময়ে তিনি নিয়মিত পত্রিকা রাখতেন। সেগুলোর অধিকাংশই পাওয়া যায়নি কারণ সেগুলো হয় হারিয়ে গেছে নতুবা সেগুলো নষ্ট করেছেন। তার কবিতায় বারবার এসেছে ধর্ম, নীতিবোধ, দেশাত্মবোধ।

তার কাবগ্রন্থের নাম 'মুকুল'। গদ্যগ্রন্থের নাম 'পৌরাণিক আখ্যায়িকা'। 'নারীত্বের আদর্শ' এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় কুসুমকুমারী স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন।

২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে ৭৩ বছর বয়সে তার মৃতু্য হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে