ভাইরাস নিয়ে কাজ করা দেশের একজন তরুণ গবেষক ইউশা আরাফ। সম্প্রতি তিনি তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের সেরা ২ শতাংশ গবেষকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। ইউশা আরাফের বৈজ্ঞানিক অর্জন কেবল একটি নির্দিষ্ট গবেষণার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং তার সব গবেষণাকর্মের জন্যই তিনি বিশ্বের সেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও এলসেভিয়ারের প্রকাশিত এই তালিকায় তার অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে তার সব প্রকাশনা, সেগুলোর সাইটেশন সংখ্যা এবং অন্যান্য গবেষণা-সম্পর্কিত মানদন্ডের ভিত্তিতে।
বর্তমানে ইউশা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে পিএইচডি করছেন। সেখানে তার গবেষণা বিশেষায়ন সংক্রামক রোগ, স্নায়ুবিজ্ঞান, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। তার এই গবেষণা প্রকল্পটি একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পের সম্প্রসারিত অংশ। যা মূলত হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সহযোগিতায় এবং আইসিডিডিআরবি ও অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত। তার কাজের প্রধান অংশ হলো সংক্রামক রোগ ও জেনেটিক রোগের কারণে শিশুর মস্তিষ্কের আকৃতি ও আকারের পরিবর্তন এবং কীভাবে এই পরিবর্তন অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে প্রভাব ফেলে, তা বিশ্লেষণ করা। আরাফ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এর আগে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োটেকনোলজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
সম্প্রতি, ইউশা এককভাবে দ্য ল্যানসেট-এ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যার ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ৯৮ দশমিক ৪। এটি বিশ্বের শীর্ষ মেডিকেল সায়েন্স জার্নাল। প্রবন্ধটিতে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের বন্যায় সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কীভাবে আমরা মোকাবিলা করতে পারি, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এতে উলেস্নখ করা হয়েছে, কীভাবে বন্যায় পানিবাহিত ও মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়িয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে ইউশা বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ও প্রস্তাব করেছেন, যা বন্যা-পরবর্তী বাংলাদেশে উদ্ভূত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
আরাফের 'সার্স-কোভ-২-এর ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট : জিনোমিক্স, সংক্রমণ ক্ষমতা এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ টিকাগুলোর প্রতিক্রিয়া-বিষয়ক গবেষণাপত্রটি জার্নাল অব মেডিকেল ভাইরোলজিতে প্রকাশিত হয়েছে। যা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ৮৬৫টিরও বেশি সাইটেশন পেয়েছে। গবেষণাপত্রটিতে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জিনোমিক মিউটেশন, সংক্রমণ ক্ষমতা এবং বিদ্যমান কোভিড-১৯ টিকাগুলোর প্রতিক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়। প্রবন্ধটির বেশি সাইটেশন সংখ্যা দেখে বোঝা যায় যে, এটি বৈজ্ঞানিক মহলে অনেক গুরুত্ব পেয়েছে এবং অন্যান্য গবেষণায় বারবার উলেস্নখ করা হয়েছে, যা গবেষণার মান এবং এর প্রাসঙ্গিকতার একটি ভালো প্রমাণ।
ইউশা শুধুমাত্র ওমিক্রন নিয়ে কাজ করেননি। তার অন্যান্য গবেষণাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাইরাসের জেনোমিক বৈশিষ্ট্য, ভ্যাকসিন ডিজাইন, ইমিউনোইনফরমেটিক্স এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের ওপর কাজ। ইতোমধ্যে তার ৭০টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ইউশা আরাফের বিজ্ঞানী হিসেবে যাত্রা কেবলমাত্র গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব এবং বৈজ্ঞানিক কূটনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মেশিন (আইজিইএম) প্রতিযোগিতায় বিচারক নির্বাচিত হন, যা তার জন্য একটি বিরাট সম্মানজনক অর্জন। আইজিইএম পৃথিবীর জীববিজ্ঞান এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা, যেখানে সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীরা তাদের উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে।
ইউশার সবগুলো গবেষণাপত্রের সাইটেশন সংখ্যা দুই হাজার ৩৫৫-এরও বেশি, যা তার গবেষণাকর্মের একাগ্রতার প্রমাণ দেয়। তার এইচ-ইনডেক্স ২৪, যা থেকে বোঝা যায়, গবেষণাপত্রগুলো গবেষকরা ব্যাপকভাবে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং অন্যদের গবেষণায় প্রভাব ফেলেছে।
ইউশা আরাফ ২০২৩ সালে জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ-বিষয়ক দপ্তরের (ইউএনওডিএ) 'ইয়ুথ ফর বায়োসিকিউরিটি ফেলোশিপথ প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হন। এই ফেলোশিপটি বিশ্বব্যাপী তরুণ গবেষকদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ, যা তাদের বায়োসিকিউরিটি এবং নিরস্ত্রীকরণ-বিষয়ক বিষয়গুলোতে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। ইউশার নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সম্মানের বিষয়, কারণ এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি বিশ্বজুড়ে বায়োসিকিউরিটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ অর্জন করেন। সম্প্রতি তিনি দ্য রয়াল সোসাইটি অব বায়োলজির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
ইউশা বলেন, আমি সার্স-কোভ-২ এবং এর বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা করেছি, বিশেষ করে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছি। আমার গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে এই ভাইরাস বিদ্যমান টিকাগুলোর প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে এবং দ্রম্নত ছড়ায়, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইমিউনোইনফরমেটিক্স ও ভ্যাকসিন ডিজাইনেও কাজ করেছি, যেখানে নতুন ভ্যাকসিন ডিজাইন করেছি। বিশেষ করে মিউকোরমাইকোসিস ও এপস্টেইন-বার ভাইরাসের বিরুদ্ধে সাবইউনিট ভ্যাকসিন তৈরি করেছি। এতে বায়োইনফরমেটিক্স ব্যবহার করে প্রতিরোধমূলক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, আমি গবেষণা করেছি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক নিয়ে। পাশাপাশি, একাধিক সংক্রমণ বা কো-ইনফেকশন নিয়ে কাজ করেছি, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
রিসার্চের প্রতি আগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, গবেষণার প্রতি আমার আগ্রহ শুরু হয় স্কুলজীবনে। অষ্টম শ্রেণিতে আমার শিক্ষক দুলাল চন্দ্র বণিক প্রথমবার আমাকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজির সঙ্গে পরিচয় করান। সেখান থেকেই জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়। পরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় এই আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এবং আমি গবেষণার প্রতি একাগ্র হয়ে উঠি।
ভবিষ্যৎ গবেষণার পরিকল্পনার বিষয়ে ইউশা আরাফ বলেন, আমার প্রধান লক্ষ্য হলো- বাংলাদেশের শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন। পিএইচডি শেষ করে আমি শিশুদের জেনেটিক রোগ এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং এসব সমস্যার সমাধানে কাজ করতে চাই। বর্তমানে আমার পিএইচডি গবেষণা এই বিষয়গুলোতেই ভিত্তি করে। আমি বিশ্বাস করি, শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দ্রম্নত ও কার্যকরভাবে সমাধান করতে পারলে দেশের শিশু মৃতু্যর হার উলেস্নখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হবে। এতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।