সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে ৪ বছরেও ২৩টি মোবাইল ক্রেন কিনতে পারেনি চবক

একই ক্রেন ক্রয় বাজেট ৬৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালের টেন্ডারে সর্বনিম্ন দর ৫৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফা টেন্ডারে ৭৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা যা বাজেট থেকে প্রায় ৬ কোটি টাকা বেশি। ২০২০ সালের দর থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা বেশি
আবদুল মোনাফ, চট্টগ্রাম
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

চট্টগ্রাম বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হচ্ছে বিভিন্ন সক্ষমতার ক্রেন। ফলে ১০৪টি সরঞ্জাম ক্রয় প্রকল্প গ্রহণ করে চবক। এ প্রকল্পের আওতায় অতি জরুরি ১০ টন ক্ষমতার ২৩টি মোবাইল ক্রেন কেনার প্রক্রিয়া বিগত সাড়ে চার বছরে তিনবার দরপত্র আহ্বান করলেও অদৃশ্য কারণে তা শেষ করতে পারেনি। এর আগে ২০১৯ সালের ১০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ৮টি মোবাইল ক্রেন ক্রয় প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে। নানা জটিলতায় গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম কেনা সম্ভব না হওয়ায় বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে সমস্যার কথা বলছেন বিভিন্ন সূত্র। ২৩টি মোবাইল ক্রেনের বাজেট ৬৯ কোটি টাকা হলেও ২০২০ সালে সর্বনিম্ন দরদাতার দর ছিল ৫৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয়বার দরপত্রে প্রায় ৬ কোটি টাকা বাড়তি দরে ৭৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করলেও পিজি জমা দিতে না পারায় ওই দরপত্র বাতিল হয়। চলতি বছর পুনরায় দরপত্র আহ্বান করলে অংশগ্রহণকারী চার প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অপর তিন প্রতিষ্ঠানের প্রাইজ সিডিউল খোলা হয়নি বলে জানা গেছে। ওই ক্রেন ক্রয়ে ২০২০ সালের প্রথম দর থেকে বর্তমান দর প্রায় ২০ কোটি টাকা বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব কর্মকান্ড চবকের বর্তমান চেয়ারম্যান যোগদান করার আগের ঘটনা।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কন্টেনার ও পণ্য হ্যান্ডলিং হয়। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত বিভিন্ন সক্ষমতার ভারী সরঞ্জামের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নানা ধরনের ক্রেন। বন্দরের সরঞ্জাম ক্রয় প্রকল্পের আওতায় বন্দরের ব্যয় সাশ্রয় বিবেচনায় কন্টেনার থেকে খালাসকৃত পণ্য পরিবহণে লোড-আনলোড করতে বন্দরে ছোট ক্রেনের সংকট থাকায় ২০২০ সালে ১০ টন ধারণ ক্ষমতার ২৩টি মোবাইল ক্রেন কেনার উদ্যোগ নেয় চবক। কারণ ১০ টন ক্রেন দিয়ে যে কাজ করা সম্ভব সে কাজ বড় ক্রেন দিয়ে করলে পরিবহণ ব্যয় বহু গুণ বেড়ে যায়। তবে ১০ টন ক্ষমতার ক্রেন ব্যবহারে বন্দরের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হয়।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২৩টি ১০ টন ক্ষমতার ক্রেন কেনার জন্য প্রথম দরপত্র আহ্বান করে ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। টেন্ডারে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহন করেন। দরপত্রে ইকম হোল্ডিংস (প্রা.) লিমিটেড ৫৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দর দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা মনোনীত হয়। তাদের রেসপন্সিভ করে কার্যাদেশ দেওয়ার ব্যাপারে ২০২১ সালের ২০ জুন বোর্ড সভার ১৮৪৬৩ নং সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য সচিব বরাবরে পত্র দেন চবক। দুদকের একটি মামলার রেফারেন্স উলেস্নখ করে কার্যাদেশ দেওয়ার অনুমোদন না দিয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রনালয়ের উপসচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ, স্বাক্ষরিত ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর এর একটি পত্রের মাধ্যমে চবকের ০৮টি ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন মোবাইল ক্রেন সংগ্রহের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ইকম হোল্ডিংস (প্রাঃ) লিমিটেডের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির ৮টি ১০টন ক্ষমতাসম্পন্ন মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের এলসি খোলা এবং মালামাল সরবরাহ করা না হওয়ায় সম্পাদিত চুক্তির ৮টি ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন মোবাইল ক্রেন ক্রয়ের দরপত্রটি নিষ্পত্তি করে নতুন প্রস্তাবটি নিষ্পত্তির জন্য বলেন। যদিও দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত বন্দর থানার মামলা নং- ৪(১০) ২০১৫ জিআর ২৮/২০১৫নং মামলাটি চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে ২৭/১০/২০২০ সালে নিষ্পত্তি হয়। ওই মামলায় ইকম ট্রেডের মালিক মো. রফিকুল ইসলামকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। এছাড়া চবক কর্তৃক চুক্তিনামা বাতিলের বিরুদ্ধে ইকম হোল্ডিংস (প্রাঃ) লিমিটেড কর্তৃক উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন নং- ১১৩১৪/২০১৯ করেন। ওই রিট পিটিশনের আদেশে বিজ্ঞ আদালত আবেদনকারীর ৩১/০৮/২০১৯ইং তারিখের লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার আবেদনটি আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে বন্দরের আইন কর্মকর্তার মতামতে দুর্নীতি মামলাটি আদালতে প্রমাণিত হয়নি বিধায় আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। ইকম হোল্ডিংস (প্রাঃ) লিমিটেড কর্তৃক দায়েরকৃত রিট মামলাটি প্রত্যাহার সাপেক্ষে বিগত ২৯/০৯/২০১৯ইং তারিখে প্রদত্ত চুক্তিনামা ও দরপত্র বাতিলের চিঠিখানা প্রত্যাহার করতে আইনগত কোনো বাধা নেই মর্মে মত প্রকাশ করেন। এর পরেও টেন্ডারটি বাতিল করে ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ওই টেন্ডারে চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করেন। তাদের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রাইজ সিডিউল না খোলে একটি প্রতিষ্ঠানকে বোর্ড সভার ১৮৭৮৫ নং সিদ্ধান্তক্রমে তৎকালীন চেয়ারম্যান কার্যাদেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন। ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) জমা দিতে না পারায় টেন্ডাটি আবারও বাতিল হয়। পরে চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল নতুন করে তৃতীয় দফার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। গত ৩১ মে দাখিলের শেষ দিন ছিল। টেন্ডারের দু'টি প্রতিষ্ঠান সেনেবোগেন মেশিন ফেব্রিক ও লোকাটেলি ক্রেন এসআরএল অংশগ্রহণ করেন। ওই টেন্ডারের টেকনিক্যাল সেকশনে উলেস্নখ আছে ৪.৫ মিটার রেডিয়াসে ১০ টন নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। জার্মানির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সেনেবোগেন মেশিন ফেব্রিক টেন্ডারে অংশগ্রহণকৃত ক্রেনের মডেলটির ৪.৫ মিটারে ১০ টন নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বলে জানা গেছে। যা তাদের অনলাইনে প্রকাশিত ক্যাটালগে উলেস্নখ আছে। ওই জার্মান প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি মোবাইল ক্রেন সরবরাহ করেছে। এসব ক্রেন এখনো বন্দরের কার্যক্রম বা মালামাল লোডিং আনলোডিং কাজে ভূমিকা রাখছে এবং বন্দরে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ ধরনের ছোট ক্রেন খুবই উপযোগী বলে জানা গেছে। এর পরও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কারিগরি ত্রম্নটি দেখিয়ে ক্রেন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সেনেবোগেন মেশিন ফেব্রিককে ননরেস্পন্সিভ হিসেবে বিবেচিত করায় একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান রেস্পন্সিভ হচ্ছে। ফলে দরপত্রটি একক দরপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে বন্দরের আর্থিক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। এ বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে চবক যান্ত্রিক বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এসব ক্রেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্রেন বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমে যুক্ত হলে বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়বে। তিনবার টেন্ডার আহ্বান পুরো প্রকল্পটিকে ঝুলে দিয়েছে। দ্রম্নত ক্রেনগুলো আনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে বলেও তিনি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে