বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি যুগান্তকারী মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের এই পর্বের পর দেশজুড়ে যে নতুন শাসন পরিবেশের সূচনা হয়েছে- তা যেমন নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে, তেমনই পুরনো অপরাধচক্রের বিবর্তিত রূপ নিয়েও উদ্বেগ তৈরি করেছে। এরই মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবে উঠে এসেছে মব সন্ত্রাস ও মামলা বাণিজ্য- যেগুলো পরস্পর সম্পর্কিত অপরাধ হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘মব সন্ত্রাস’ ও ‘মামলা বাণিজ্য’ এ দুটি শব্দ ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এই দুইটি যেন একই মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
মব সন্ত্রাস বলতে সাধারণ মানুষ বা সংগঠিত জনতা কর্তৃক কাউকে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শাস্তি দেওয়ার যে প্রবণতা- সেটিকে বোঝানো হয়।
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ নেয়। বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভূমিদস্যু, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও তদবির চক্রের ইন্ধনে।
মূলত মব সন্ত্রাস হলো বিচারবহির্ভুত উন্মত্ততা। জনগণের একাংশের ক্ষোভ, উত্তেজনা বা পরিকল্পিত উস্কানির ফলে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত বা হত্যা করা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে ৭৪ জন নিহত এবং প্রায় ২০০ জন আহত হয়। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯১ জনে। এর মধ্যে ৬৫% ছিল চোর সন্দেহে, ২০% ধর্মীয় গুজবের শিকার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ৩৪টি মব লিঞ্চিং এর ঘটনা ঘটেছে- যার মধ্যে ১৭টি ছিল সম্পূর্ণ গুজবভিত্তিক। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২৮ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৫৫ জন।
২০২৫ সালের মার্চে গাইবান্ধা জেলায় গুজব রটে যায় যে, এক ব্যক্তি শিশু চুরি করে পালাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ না থাকলেও স্থানীয় উসকানিদাতারা মুহূর্তেই জনতা জড়ো করে মারধর শুরু করে।
ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে তদন্তে প্রমাণিত হয়- ‘ভিকটিম একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ভিক্ষুক ছিল’। ২০২৫ সালের শুরুতে খুলনার দৌলতপুর থানায় এক নারী এনজিওকর্মীর নামে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন মামলা হয়- যার ৬টিই মিথ্যা বলে পরে প্রমাণিত হয়।
বরিশালের বাকেরগঞ্জে একটি চায়ের দোকানদারকে অবৈধ গ্যাস সংযোগের অভিযোগে মামলা দিয়ে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ‘মামলা না করার’ চুক্তি করে স্থানীয় দালাল ও এসআই।
‘গুজব’ এখন সমাজের আতঙ্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে সমাজে আইনের জনগনের অনাস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিরীহ মানুষের মৃত্যুহার বাড়ছে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারাচ্ছে।
আজকাল ডিজিটাল গুজব সমাজে বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। ‘শিশু অপহরণকারী’ সন্দেহে ভাইরাল ভিডিওর মাধ্যমে জনতা উত্তেজিত হয়। ২০২৪ সালে মোবাইলে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর কারণে ২৭টি মব সন্ত্রাস ঘটেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।অন্যদিকে, মামলা এখন আইনের অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। মামলা বাণিজ্য বলতে বোঝায়- অতিরিক্ত, ভিত্তিহীন বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে আর্থিক বা রাজনৈতিক সুবিধা আদায়। এটি আইনের অপব্যবহার করে গড়ে ওঠা একটি অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ পরায়ণতার বশবর্তী হয়ে ‘ভুয়া মামলা’, ‘ঘুষের বিনিময়ে মামলা প্রত্যাহার’ এবং ‘ভীতিপ্রদর্শন করে মামলা দিয়ে অর্থ আদায়’- এই তিন রকম মামলা বাণিজ্যের চর্চা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের ২০২৪ সালের নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে মাত্র ২ মাসে ৯ হাজার ২০০টি মামলা দায়ের করা হয়- যার মধ্যে বেশিরভাগই ‘গায়েবি মামলা’ নামে পরিচিত।
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেও অসংখ্য মামলা করা হয়- অনেক সময় ১টি ঘটনায় একাধিক থানায় একই এজাহার(!) দেওয়া হয়।
ঢাকায় একাধিক থানায় একই ব্যক্তির নামে ৩২টি মামলা দায়ের হয় মাত্র এক সপ্তাহে। তার অপরাধ? তিনি একটি ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।
সে সময়ের মামলায় অনেক থানায় ‘কমিশন বাণিজ্য’ চালু ছিল। কমিশন নিয়ে বা কমিশনের প্রতিশ্রুতিতে অনেক থানায় মামলা নিতে ঘুষ, মিথ্যা অভিযোগ রেকর্ড করানো ইত্যাদি করা হতো।
মামলা তোলার নামে অর্থ আদায়, মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ে ‘অ্যাক্টিং’ সাক্ষী তৈরি করে টাকা নেওয়া, জামিন-অযোগ্য মামলা দিয়ে ব্যক্তির জীবন বা পরিবারের ধ্বংস করার ঘটনা অনেক ঘটেছে।গণঅভ্যুত্থানের পর আগস্ট থেকে গত জুন পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৩ হাজার ৮৮১টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আদালতে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা অগণিত।
এক জনের নামেই ঢাকা ও জেলা শহগেুলো ৩০৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে(সূত্র: প্রথমআলো)। ‘থানার দালাল চক্র’ নামে পরিচিত একটি সিন্ডিকেট মিলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভূমি বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রুতার মামলাগুলোকে ‘কমার্শিয়াল’ করে তুলেছে।
এসব মামলা থেকে নাম প্রত্যাহারে কমার্শিয়াল চক্রটি টাকা নেয়। মামলা তুলতে টাকা নেয়। মামলায় নাম থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার বা আটক করবেনা বলেও টাকা নেয়।
টিআইবি ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ৭০০টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার ২০০টি ছিল ভিত্তিহীন ও প্রমাণহীন- যেগুলো আদালতে পরবর্তীতে খারিজ হয়। এছাড়া তদন্তে প্রকাশ, থানা বা আদালতের মামলা প্রত্যাহারে গড়ে প্রতি মামলায় আসামি প্রতি ৩০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করা হয়। অনেক সময় কেউ সরাসরি ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করে- যা প্ররোচনামূলক।
পরে সেই ভিত্তিতে ‘সাজানো এজাহার’ তৈরি করেও মামলা হয়। এসব বাণিজ্য ভিত্তিক মামলা সমাজে এক ধরনের অশান্তি সৃষ্টি করছে।মব সন্ত্রাস এক ধরনের জনতানির্ভর প্রতিহিংসা আর মামলা বাণিজ্য হলো প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশোধের আয়োজন। দুটির উদ্দেশ্য এক- নির্দিষ্ট কাউকে দমন বা ধ্বংস করা।
তাই বলা যায়- মব সন্ত্রাস ও মামলা বাণিজ্য একই সুতায় গাঁথা অপরাধ। দুটোই মূলত আইনের শাসনকে পাশ কাটিয়ে সামাজিক প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ক্ষমতার দখলদারিত্বকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলাফল।
দুটোরই প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে- প্রমাণ ছাড়াই শাস্তি বা হয়রানি, জনগণের আইন হাতে তুলে নেওয়ার সংস্কৃতি, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা বা সক্রিয় সহায়তা, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় প্রভাবিত হওয়া এবং দালালচক্র ও ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণ। এ দুটোই বিচারবহির্ভূত সংস্কৃতির বিস্তার করে।
মব সন্ত্রাস বিচারপ্রক্রিয়ার বাইরে মানুষকে ‘শাস্তি’ দেয় এবং মামলা বাণিজ্য বিচারপ্রক্রিয়ার ভেতর থেকেই অন্যায়কে বৈধতা দেয়। পুলিশ, দলীয় ক্যাডার, পেশাদার আইনজীবীর সমন্বয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা মামলার সিন্ডিকেট চালান। আর মব সন্ত্রাসে দলীয় উস্কানিদাতারা লুকিয়ে থাকে।২০২৪ সালে ছাত্র ও যুব সমাজের নেতৃত্বে যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা পতনের মুখে পড়ে- তার অন্যতম দাবি ছিল আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে একটি নতুন ‘প্রতিহিংসার সংস্কৃতি’ জন্ম নিচ্ছে। যেখানে যারা একসময় নিপীড়িত ছিলেন, তারাই আজ নিপীড়কের ভূমিকায়।
ফলে গণতন্ত্রের শক্ত ভিত গড়ে ওঠার পরিবর্তে এক ধরনের ‘পুনরুৎপাদিত স্বৈরতন্ত্র’ তৈরি হচ্ছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ- যা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত।তবে এই অর্জনের সুফল ম্লান হয়ে যেতে পারে যদি ‘মব সন্ত্রাস’ ও ‘মামলা বাণিজ্য’ অব্যাহত থাকে। গণঅভ্যুত্থানের পর নানা স্থানে জনগণের আবেগকে পুঁজি করে বিচার বহির্ভূতভাবে ‘মব’ দ্বারা শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে- যা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি।
একইসঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটানো বা অর্থনৈতিক সুযোগ নেওয়ার জন্য মামলা বাণিজ্যের ভয়াবহতা বেড়েছে। শ’ শ’ নাম-উল্লেখবিহীন মামলা, জামিনে হয়রানি, পুলিশের ‘ভাড়ায় তদন্ত’ এসব পুরনো অপপ্রক্রিয়া নতুনরাও অনুসরণ করলে জনআস্থা নষ্ট হবে।
ফলে গণঅভ্যুত্থানের আসল লক্ষ্য- ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন বিফলে যেতে পারে। এইসব অনিয়ম রোধ না করলে অরাজকতা নতুন রূপে ফিরে দেশে আবারও বিভ্রান্তি ও অনাস্থা তৈরি করতে পারে। তাই গণতন্ত্র রক্ষায় মব সন্ত্রাস ও মামলা বাণিজ্য কঠোরভাবে দমন করা প্রয়োজন।দেশে বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি, প্রভাবশালী অপরাধীদের অব্যাহতি, তদন্তে দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত আজ আইনকেই পণ্যের মতো কেনাবেচার বস্তু বানিয়ে ফেলেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, একাধিক ওসি ও এসআই হঠাৎ করে ‘আয় বহির্ভূত সম্পদের’ তদন্তের মুখে পড়েছেন- মামলা বাণিজ্য সিন্ডিকেটে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
মব সন্ত্রাস এবং মামলা বাণিজ্য- উভয়ের ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গুজব, বিভ্রান্তিকর ভিডিও ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পোস্টও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
মিডিয়া ট্রায়ালের সংস্কৃতি বিচার না হতেই ‘অপরাধী সাব্যস্ত’ করে দেওয়ার প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।আশার কথা, মব সন্ত্রাস বা ভায়োলেন্স ও মামলা বাণিজ্য নিয়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- মব সন্ত্রাস প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা, মামলা বাণিজ্য রোধে পুলিশ সদস্যদের সম্পদের উৎস যাচাই কার্যক্রম, আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
কিন্তু পদক্ষেপগুলো প্রশাসন, পুলিশ, আদালত ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অনীহা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও মব সন্ত্রাস ও মামলা বাণিজ্য বন্ধে সভা-সমাবেশ ও মিডিয়ায় বক্তব্য রাখছেন। মিডিয়া তা ফলাও করে প্রচারও করছে।
কিন্তু মব ভায়োলেন্স ও মামলা বাণিজ্য থামছেনা বরং এর প্রভাব সমাজ থেকে পরিবারে পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটছে। ফলে মব ভায়োলেন্স ও মামলা বাণিজ্য বাঙালির কালচারে রূপ নেওয়ার ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে।আমরা মনেকরি, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের পাশাপাশি মামলার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিতকরণে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, মিথ্যা মামলার জন্য প্রতিশোধমূলক শাস্তির বিধান, সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো প্রতিরোধে কড়া নজরদারি ও জনশিক্ষা অতীব প্রয়োজন। এজন্য (ক) ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার (খ) পুলিশি তদন্তকে স্বাধীন ও প্রযুক্তিনির্ভর করা (গ) ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ আদালত প্রতিষ্ঠা করে মব সন্ত্রাসের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি (ঘ) আইনজীবী, বিচারক, পুলিশ ও সাংবাদিকদের জন্য একযোগে প্রশিক্ষণ (ঙ) গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি ও সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ (চ) আইনের অপপ্রয়োগ করলে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের শাস্তির বিধান কার্যকর (ছ) সিভিল সোসাইটি ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অধিকতর অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক।
মব সন্ত্রাস ও মামলা বাণিজ্য এই দুটি বিচ্ছিন্ন নয় বরং একই রকমের সামাজিক ব্যাধি। একটির শিকার হয় জনতার হাতে, অন্যটির শিকার হয় আইনের অপব্যবহারে। এটি শুধু ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের নৈতিক পরাজয়। রাষ্ট্র যদি আইন ও বিচার নিশ্চিত করতে না পারে- তাহলে সমাজে নৈরাজ্য বাড়বে, বিচারহীনতা হবে নতুন স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক সমাজে বিচারবহির্ভূত শাস্তি ও আইনের নামে বাণিজ্য- এই দুইটি সবচেয়ে বড় হুমকি। যেখানে ন্যায়বিচারকে বিকিয়ে দেওয়া হয় প্রতিহিংসা ও লোভের কাছে।
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান যে আশা জাগিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন এই অপরাধপ্রবণতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চকণ্ঠে বলার সময় এসেছে, আইনকে ব্যবসা ও প্রতিশোধের হাতিয়ার না বানিয়ে- মানবিকতা প্রমাণ এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র শুধু একটি কাগুজে শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে- মানুষের জীবনে এর কোনও অর্থ থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
ই-মেইলঃ নঁষনঁষসঁষষরপশ@মসধরষ.পড়স