সারাদেশ
মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ
মো. নূরুল হক কবির, হবিগঞ্জ
মহান মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল এম এ রব, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, অন্যতম সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত বীর উত্তম, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এবং স্বাধীনতাপদক প্রাপ্ত সাবেক অর্থ মন্ত্রী শাহ্ এ এস এম কিবরিয়া এ জেলারই কৃতি সন্তান। জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি ১৯৭১ সালের ৪এপ্রিল ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে সমগ্র দেশকে ৪টি সেক্টরে বিভাজন করেন, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষীস্বরূপ এখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ, হবিগঞ্জ কর্তৃক এই স্মৃতিস্তম্ভের ব্যাপক সংস্কার কাজ করার ফলে এটি এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
তেলিয়াপাড়া স্মৃতি সৌধ ও ঐতিহাসিক ডাকবাংলো
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে বর্বর হামলার পর দেশের অবস্থা যখন টালমাটাল, প্রতিরোধের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি, তখন ৪এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় ২৭ সেনা অফিসারের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে ৪ সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ৪ সেনা কর্মকর্তাকে ৪টি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৪ সেক্টরকে কাজের সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ বৈঠকেই সেনা কর্মকর্তাগন দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহন করেন। বৈঠট শেষে মুক্তিযদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি উসমানি নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোটিকে ৪ঠা এপ্রিল থেকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ও পরে ৩ এবং ৪ নং নম্বর সেক্টর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে একটি বড় প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের র্সবাধিনায়ক আতাউল গনি উসমানী সহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগন বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়র্টার তুলে নেয়া হয়। মহান স্বধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত তেলিয়াপাড়া চা বাগান স্মৃতি সৌধ এলাকা এখন আকর্ষনীয় পিকনিক স্পটে পরিনিত হয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুম আসার সাথে সাথে সৌন্দর্য পিপাসুরা পিকনিক করতে ছুটে আসেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে।
বধ্যভূমি
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত হবিগঞ্জে প্রায় ২০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এসকল বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে।
সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমি
হবিগঞ্জের মাধবপুরের সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে এবং শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। চা-শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে। তাদের কয়েকজনের মধ্যে হলেন আয়ছর আলী, আবদুল আজিজ, নাজিম উদ্দিন, প্রেমসিং মাকি মুন্ডা, চান্দা মুন্ডা, চুনু সাঁওতাল প্রমুখ।
মাকালকান্দি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালে ১৭ আগস্ট সকাল ৯টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌকাযোগে লাখাই উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে আসে। গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। তখন গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় নির্মিত চন্ডীমন্ডপে বিষহরি পূজার আয়োজন চলছিল এবং গ্রামবাসী সেখানে অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গ্রামের বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে চন্ডীমন্ডপের সামনে লাইনে করে দাড় করিয়ে ৮২ থেকে ৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাদের কয়েকজনের নাম হলো অভিনয় দাস, সূর্য কুমার দাস, তরণী কান্ত দাস, গিরিন্দ্র কুমার দাস, ধীরেন্দ্র কুমার দাস, কৃপেন্দ্র সরকার, নকুল চন্দ্র দাস, কর্ণ সরকার, অন্নদাচরণ দাস, সুভাষিণী দাস, সরলা রাণী দাস, খুশি রাণী দাস, অমরি রাণী দাস, মানদা বালা দাস, তমাল রাণী দাস, সুভা রাণী দাস, সুরেন্দ্র দাস, কুমুদিনী দাস, শৈবালিনী দাস, গিরীশ সরকার, শ্যামল বালা দাস, বিধান চন্দ্র দাস প্রমুখ।
নজিপুর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দালাল আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী, আবদুল মছব্বির চৌধুরী ও ফজলুল হক মতওল্ডীর তৎপরতায় পাকিস্তানি বাহিনী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নজিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে গ্রামটিকে ঘেরাও করে গুলি শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে-বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। কিছু লোক হাওরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। এখানে প্রায় ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন কমল চন্দ্র দাস, ষোড়শী ছায়া রাণী দাস, বারীন্দ্র চন্দ্র দাস, সুনীতি বালা দাস, মীনা রাণী দাস, ঝরনা রাণী দাস, মাধুরী রাণী দাস, সুবল চন্দ্র নবশূদ্র, প্রফুল্লীময়ী দাস, গোসাইরাম নবশূদ্র, গবিন্দ্র চন্দ্র নবশূদ্র, বিদ্যাবন নবশূদ্র প্রমুখ।
ননীগোপাল রায়বাড়ি বধ্যভূমি
নৌযোগে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কৃৃষ্ণপুর গ্রামে আসে। এখানে আসার পর গ্রামটি চারদিকে ঘিরে ফেলে এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এক সময় ননী গোপাল রায়ের বাড়িতে ৩২ জন মুক্তিকামী মানুষকে একত্র করে। তারপর চলে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। এ ঘটনায় প্রায় ২৮ জন শহীদ হন। তাদের মধ্যে কয়েক হলেন ননী গোপাল চক্রবর্তী, সুকুমার সূত্রধর, রামা চরণ রায়, মহেন্দ্র রায়, জয়কুমার রায়, ক্ষিতীশ গোপ, রেবতী মোহন রায় প্রমুখ।
চুনারুঘাট বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজাকারদের সহযোগিতায় চুনারুঘাটে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পটি এখানে ছিল সাত মাস। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করার পর হত্যা করা হতো। এখানে এমনি হত্যার শিকার হন গোছাপাড়া গ্রামের যোগেন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র পাল, যোগেশ শুক্ল বৈদ্য ও তার ছোট ভাই, চান্দপুর চা-বাগানের শ্রমিক নিবারং উরাং, কার্তিক ইয়ামুদসহ আরও তিনজন শ্রমিক। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী চুনারুঘাটের হাতুন্ডা গ্রামের যামিনী মোহনদের বাড়িকে পরিণত করে একটি পতিতালয়ে। সেখানে তাঁর স্ত্রীকে বর্বর পাকিস্তানিরা প্রতিদিন পালাক্রমে ধর্ষণ করত।
শ্রীরামসি বধ্যভূমি
জগন্নাথপুরের শ্রীরামসি গ্রামে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল ৯টায় ৭-৮টি নৌকা বোঝাই হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েকজন রাজাকারসহ শ্রীরামসি গ্রামে আসে। শান্তি কমিটির নাম করে সবাইকে এক জায়গায় আসার আহবান করা হলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি। তারপর সকাল ১০টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রের মুখে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে শ্রীরামসি স্কুল মাঠে নিয়ে আসে। এ মাঠে সবাইকে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, এহিয়া চৌধুরী, সত্যেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল আজিজ, দবির মিয়া, আবদুল মান্নান, সবুজ মিয়া প্রমুখ।
রানীগঞ্জ বাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পাকিস্তানি বাহিনী রানীগঞ্জ বাজার ঘিরে ফেলে এবং বাজারের দুই শতাধিক মানুষকে বেঁধে এক লাইনে দাড় করায়। তারপর তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন তছর উদ্দিন, সোনাহর আলী, আলতা মিয়া, মদরিছ উল্লা, ধন মিয়া, মিছির আলী, আবদুল হেকিম, আপিল মাহমুদ, আছাল মিয়া, ছয়েব উদ্দিন, আতাউর রহমান, বোরহান উদ্দিন প্রমুখ।
অবহেলিত শায়েস্তাগঞ্জ বধ্যভূমিঃ
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ রেল জংশনের পাশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দলিল, বধ্যভূমির যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষন ও মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে না। বধ্যভূমির পাশেই রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পৌর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামে একটি কার্যালয় রয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বধ্যভূমিটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীন।
শায়েস্তাগঞ্জের এই বধ্যভূমিটি পাচ্ছে না উপযুক্ত মর্যাদা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিটি রেল লাইন সংলগ্ন হওয়ায় রেল লাইন অতিক্রম করা ছাড়া যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। কিছুদিন পূর্বে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ মেইন রোড থেকে বধ্যভূমিতে যাতায়াতের সুবিধার্থে একটি স্বতন্ত্র পাকা সড়ক নির্মাণ করা হলেও সড়কটি সিএনজি অটোরিক্সার দখলে। এ সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচলের কোন পরিবেশ নেই। এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ইউনিট কমান্ডার ও বর্তমান জেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌরপ্রসাদ রায় জানান, বধ্যভূমির পাশর্^বর্তী দিঘীর পাড়ে আমগাছের ছায়ায় সিএনজি স্ট্যান্ডটি স্থানান্তর করা হবে।
সিএনজি স্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য সেখানে মাটিও ভরাট করা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে বধ্যভূমির এই সড়কটি স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে এই সড়ক সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই।
অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে ফয়জাবাদ বধ্যভূমি
অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে বাহুবলের ফয়জাবাদ বধ্যভূমি। ঝুঁপঝাড়ের আড়ালে পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এই স্মৃতি স্থাপনাটি। বধ্যভূমির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেলেও তা সংস্কারের নেই কোনো উদ্যোগ। মাঝেমধ্যে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ এখানে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করলেও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না কেউ। উপরে উঠার সিড়িতে রেলিং না থাকায় উপরে উঠতে পারেন না বয়স্করা। একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ছাড়া আর কোন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানও হয় না এখানে।
বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গণহত্যা
’৭১ এর ১৮ আগস্ট। বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গ্রামে চন্ডি মন্দিরে চলছিল পূজার প্রস্তুতি। কেউ সাজাচ্ছিলেন পূজোর থালা। অনেকেই ব্যস্ত ফুল সংগ্রহে। এরই মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ৪৪ নারীসহ ৭৮ জন নিরপরাধ হিন্দুকে নির্বিচারে হত্যা করে হায়েনার দল। লাশগুলো ভাসিয়ে দেয়া হয় পানিতে।
সেই লাশের মিছিল স্বচক্ষে দেখেছেন মিনতী রাণী পাল। এমনকি মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মিনতীর শিশু বাচ্চাও। হত্যার পর শিশুটিকে ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ভয়াল সেই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিনতি।
একই ঘটনার স্বাক্ষী জয়তারা। আজও বেঁচে আছেন লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতি নিয়ে। জয়তারার তিন বছরের বাচ্চাকে টেনে নিয়ে বুটের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করে হানাদারবাহিনী। গুলি করে হত্যা করা হয় তার মেয়ে, স্বামী ও ভাইকে। লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয় তাকেও। তবে বেঁচে যান ভাগ্যগুণে। ওই দৃশ্য মনে হলে এখনও ঘুমাতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন জয়তারা। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রাননাথ দাস বলেন, সবাই ব্যস্ত ছিল পূজো নিয়ে। সকাল নয়টায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করে গ্রামে। পাখির মতো মারতে থাকে মানুষ। কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে ভাগ্যগুণে প্রাণে রক্ষা পায়। তবে মেরে ফেলা হয়েছে ৭৮ জনকে।
তিনি বলেন, আমার চোখের সামনে বাবা বোন ফুফুসহ অনেককেই মরতে দেখেছি। কাতরাতে দেখেছি মৃত্যু যন্ত্রণায়। তখন নৌকা থেকে বেরিয়ে আসা রাজাকার ফজলুল হককে আমি পরিচয় দেই আমি মুসলমান। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।
যাযাদি/এসএইচ
সারাদেশ
মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ
মো. নূরুল হক কবির, হবিগঞ্জ
মহান মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল এম এ রব, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, অন্যতম সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত বীর উত্তম, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এবং স্বাধীনতাপদক প্রাপ্ত সাবেক অর্থ মন্ত্রী শাহ্ এ এস এম কিবরিয়া এ জেলারই কৃতি সন্তান। জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি ১৯৭১ সালের ৪এপ্রিল ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে সমগ্র দেশকে ৪টি সেক্টরে বিভাজন করেন, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষীস্বরূপ এখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ, হবিগঞ্জ কর্তৃক এই স্মৃতিস্তম্ভের ব্যাপক সংস্কার কাজ করার ফলে এটি এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
তেলিয়াপাড়া স্মৃতি সৌধ ও ঐতিহাসিক ডাকবাংলো
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে বর্বর হামলার পর দেশের অবস্থা যখন টালমাটাল, প্রতিরোধের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি, তখন ৪এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় ২৭ সেনা অফিসারের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে ৪ সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ৪ সেনা কর্মকর্তাকে ৪টি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৪ সেক্টরকে কাজের সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ বৈঠকেই সেনা কর্মকর্তাগন দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহন করেন। বৈঠট শেষে মুক্তিযদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি উসমানি নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোটিকে ৪ঠা এপ্রিল থেকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ও পরে ৩ এবং ৪ নং নম্বর সেক্টর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে একটি বড় প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের র্সবাধিনায়ক আতাউল গনি উসমানী সহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগন বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়র্টার তুলে নেয়া হয়। মহান স্বধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত তেলিয়াপাড়া চা বাগান স্মৃতি সৌধ এলাকা এখন আকর্ষনীয় পিকনিক স্পটে পরিনিত হয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুম আসার সাথে সাথে সৌন্দর্য পিপাসুরা পিকনিক করতে ছুটে আসেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে।
বধ্যভূমি
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত হবিগঞ্জে প্রায় ২০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এসকল বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে।
সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমি
হবিগঞ্জের মাধবপুরের সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে এবং শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। চা-শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে। তাদের কয়েকজনের মধ্যে হলেন আয়ছর আলী, আবদুল আজিজ, নাজিম উদ্দিন, প্রেমসিং মাকি মুন্ডা, চান্দা মুন্ডা, চুনু সাঁওতাল প্রমুখ।
মাকালকান্দি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালে ১৭ আগস্ট সকাল ৯টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌকাযোগে লাখাই উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে আসে। গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। তখন গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় নির্মিত চন্ডীমন্ডপে বিষহরি পূজার আয়োজন চলছিল এবং গ্রামবাসী সেখানে অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গ্রামের বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে চন্ডীমন্ডপের সামনে লাইনে করে দাড় করিয়ে ৮২ থেকে ৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাদের কয়েকজনের নাম হলো অভিনয় দাস, সূর্য কুমার দাস, তরণী কান্ত দাস, গিরিন্দ্র কুমার দাস, ধীরেন্দ্র কুমার দাস, কৃপেন্দ্র সরকার, নকুল চন্দ্র দাস, কর্ণ সরকার, অন্নদাচরণ দাস, সুভাষিণী দাস, সরলা রাণী দাস, খুশি রাণী দাস, অমরি রাণী দাস, মানদা বালা দাস, তমাল রাণী দাস, সুভা রাণী দাস, সুরেন্দ্র দাস, কুমুদিনী দাস, শৈবালিনী দাস, গিরীশ সরকার, শ্যামল বালা দাস, বিধান চন্দ্র দাস প্রমুখ।
নজিপুর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দালাল আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী, আবদুল মছব্বির চৌধুরী ও ফজলুল হক মতওল্ডীর তৎপরতায় পাকিস্তানি বাহিনী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নজিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে গ্রামটিকে ঘেরাও করে গুলি শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে-বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। কিছু লোক হাওরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। এখানে প্রায় ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন কমল চন্দ্র দাস, ষোড়শী ছায়া রাণী দাস, বারীন্দ্র চন্দ্র দাস, সুনীতি বালা দাস, মীনা রাণী দাস, ঝরনা রাণী দাস, মাধুরী রাণী দাস, সুবল চন্দ্র নবশূদ্র, প্রফুল্লীময়ী দাস, গোসাইরাম নবশূদ্র, গবিন্দ্র চন্দ্র নবশূদ্র, বিদ্যাবন নবশূদ্র প্রমুখ।
ননীগোপাল রায়বাড়ি বধ্যভূমি
নৌযোগে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কৃৃষ্ণপুর গ্রামে আসে। এখানে আসার পর গ্রামটি চারদিকে ঘিরে ফেলে এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এক সময় ননী গোপাল রায়ের বাড়িতে ৩২ জন মুক্তিকামী মানুষকে একত্র করে। তারপর চলে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। এ ঘটনায় প্রায় ২৮ জন শহীদ হন। তাদের মধ্যে কয়েক হলেন ননী গোপাল চক্রবর্তী, সুকুমার সূত্রধর, রামা চরণ রায়, মহেন্দ্র রায়, জয়কুমার রায়, ক্ষিতীশ গোপ, রেবতী মোহন রায় প্রমুখ।
চুনারুঘাট বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজাকারদের সহযোগিতায় চুনারুঘাটে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পটি এখানে ছিল সাত মাস। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করার পর হত্যা করা হতো। এখানে এমনি হত্যার শিকার হন গোছাপাড়া গ্রামের যোগেন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র পাল, যোগেশ শুক্ল বৈদ্য ও তার ছোট ভাই, চান্দপুর চা-বাগানের শ্রমিক নিবারং উরাং, কার্তিক ইয়ামুদসহ আরও তিনজন শ্রমিক। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী চুনারুঘাটের হাতুন্ডা গ্রামের যামিনী মোহনদের বাড়িকে পরিণত করে একটি পতিতালয়ে। সেখানে তাঁর স্ত্রীকে বর্বর পাকিস্তানিরা প্রতিদিন পালাক্রমে ধর্ষণ করত।
শ্রীরামসি বধ্যভূমি
জগন্নাথপুরের শ্রীরামসি গ্রামে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল ৯টায় ৭-৮টি নৌকা বোঝাই হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েকজন রাজাকারসহ শ্রীরামসি গ্রামে আসে। শান্তি কমিটির নাম করে সবাইকে এক জায়গায় আসার আহবান করা হলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি। তারপর সকাল ১০টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রের মুখে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে শ্রীরামসি স্কুল মাঠে নিয়ে আসে। এ মাঠে সবাইকে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, এহিয়া চৌধুরী, সত্যেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল আজিজ, দবির মিয়া, আবদুল মান্নান, সবুজ মিয়া প্রমুখ।
রানীগঞ্জ বাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পাকিস্তানি বাহিনী রানীগঞ্জ বাজার ঘিরে ফেলে এবং বাজারের দুই শতাধিক মানুষকে বেঁধে এক লাইনে দাড় করায়। তারপর তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন তছর উদ্দিন, সোনাহর আলী, আলতা মিয়া, মদরিছ উল্লা, ধন মিয়া, মিছির আলী, আবদুল হেকিম, আপিল মাহমুদ, আছাল মিয়া, ছয়েব উদ্দিন, আতাউর রহমান, বোরহান উদ্দিন প্রমুখ।
অবহেলিত শায়েস্তাগঞ্জ বধ্যভূমিঃ
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ রেল জংশনের পাশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দলিল, বধ্যভূমির যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষন ও মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে না। বধ্যভূমির পাশেই রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পৌর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামে একটি কার্যালয় রয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বধ্যভূমিটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীন।
শায়েস্তাগঞ্জের এই বধ্যভূমিটি পাচ্ছে না উপযুক্ত মর্যাদা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিটি রেল লাইন সংলগ্ন হওয়ায় রেল লাইন অতিক্রম করা ছাড়া যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। কিছুদিন পূর্বে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ মেইন রোড থেকে বধ্যভূমিতে যাতায়াতের সুবিধার্থে একটি স্বতন্ত্র পাকা সড়ক নির্মাণ করা হলেও সড়কটি সিএনজি অটোরিক্সার দখলে। এ সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচলের কোন পরিবেশ নেই। এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ইউনিট কমান্ডার ও বর্তমান জেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌরপ্রসাদ রায় জানান, বধ্যভূমির পাশর্^বর্তী দিঘীর পাড়ে আমগাছের ছায়ায় সিএনজি স্ট্যান্ডটি স্থানান্তর করা হবে।
সিএনজি স্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য সেখানে মাটিও ভরাট করা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে বধ্যভূমির এই সড়কটি স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে এই সড়ক সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই।
অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে ফয়জাবাদ বধ্যভূমি
অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে বাহুবলের ফয়জাবাদ বধ্যভূমি। ঝুঁপঝাড়ের আড়ালে পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এই স্মৃতি স্থাপনাটি। বধ্যভূমির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেলেও তা সংস্কারের নেই কোনো উদ্যোগ। মাঝেমধ্যে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ এখানে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করলেও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না কেউ। উপরে উঠার সিড়িতে রেলিং না থাকায় উপরে উঠতে পারেন না বয়স্করা। একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ছাড়া আর কোন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানও হয় না এখানে।
বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গণহত্যা
’৭১ এর ১৮ আগস্ট। বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গ্রামে চন্ডি মন্দিরে চলছিল পূজার প্রস্তুতি। কেউ সাজাচ্ছিলেন পূজোর থালা। অনেকেই ব্যস্ত ফুল সংগ্রহে। এরই মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ৪৪ নারীসহ ৭৮ জন নিরপরাধ হিন্দুকে নির্বিচারে হত্যা করে হায়েনার দল। লাশগুলো ভাসিয়ে দেয়া হয় পানিতে।
সেই লাশের মিছিল স্বচক্ষে দেখেছেন মিনতী রাণী পাল। এমনকি মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মিনতীর শিশু বাচ্চাও। হত্যার পর শিশুটিকে ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ভয়াল সেই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিনতি।
একই ঘটনার স্বাক্ষী জয়তারা। আজও বেঁচে আছেন লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতি নিয়ে। জয়তারার তিন বছরের বাচ্চাকে টেনে নিয়ে বুটের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করে হানাদারবাহিনী। গুলি করে হত্যা করা হয় তার মেয়ে, স্বামী ও ভাইকে। লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয় তাকেও। তবে বেঁচে যান ভাগ্যগুণে। ওই দৃশ্য মনে হলে এখনও ঘুমাতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন জয়তারা। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রাননাথ দাস বলেন, সবাই ব্যস্ত ছিল পূজো নিয়ে। সকাল নয়টায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করে গ্রামে। পাখির মতো মারতে থাকে মানুষ। কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে ভাগ্যগুণে প্রাণে রক্ষা পায়। তবে মেরে ফেলা হয়েছে ৭৮ জনকে।
তিনি বলেন, আমার চোখের সামনে বাবা বোন ফুফুসহ অনেককেই মরতে দেখেছি। কাতরাতে দেখেছি মৃত্যু যন্ত্রণায়। তখন নৌকা থেকে বেরিয়ে আসা রাজাকার ফজলুল হককে আমি পরিচয় দেই আমি মুসলমান। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।
যাযাদি/এসএইচ
মহান মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল এম এ রব, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, অন্যতম সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত বীর উত্তম, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও সাবেক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এবং স্বাধীনতাপদক প্রাপ্ত সাবেক অর্থ মন্ত্রী শাহ্ এ এস এম কিবরিয়া এ জেলারই কৃতি সন্তান। জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি ১৯৭১ সালের ৪এপ্রিল ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে সমগ্র দেশকে ৪টি সেক্টরে বিভাজন করেন, যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষীস্বরূপ এখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ, হবিগঞ্জ কর্তৃক এই স্মৃতিস্তম্ভের ব্যাপক সংস্কার কাজ করার ফলে এটি এখন দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
তেলিয়াপাড়া স্মৃতি সৌধ ও ঐতিহাসিক ডাকবাংলো
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে বর্বর হামলার পর দেশের অবস্থা যখন টালমাটাল, প্রতিরোধের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি, তখন ৪এপ্রিল মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় ২৭ সেনা অফিসারের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণকে ৪ সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ৪ সেনা কর্মকর্তাকে ৪টি সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে ৪ সেক্টরকে কাজের সুবিধার্থে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ বৈঠকেই সেনা কর্মকর্তাগন দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহন করেন। বৈঠট শেষে মুক্তিযদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি উসমানি নিজের পিস্তল থেকে ফাঁকা গুলি করে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
তেলিয়াপাড়া চা বাগান ম্যানেজার বাংলোটিকে ৪ঠা এপ্রিল থেকে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর ও পরে ৩ এবং ৪ নং নম্বর সেক্টর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে একটি বড় প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের র্সবাধিনায়ক আতাউল গনি উসমানী সহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডারগন বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়র্টার তুলে নেয়া হয়। মহান স্বধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত তেলিয়াপাড়া চা বাগান স্মৃতি সৌধ এলাকা এখন আকর্ষনীয় পিকনিক স্পটে পরিনিত হয়েছে। প্রতি বছর শীত মৌসুম আসার সাথে সাথে সৌন্দর্য পিপাসুরা পিকনিক করতে ছুটে আসেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে।
বধ্যভূমি
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত হবিগঞ্জে প্রায় ২০টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এসকল বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে।
সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমি
হবিগঞ্জের মাধবপুরের সুরমা চা-বাগান বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে এবং শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। চা-শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে। তাদের কয়েকজনের মধ্যে হলেন আয়ছর আলী, আবদুল আজিজ, নাজিম উদ্দিন, প্রেমসিং মাকি মুন্ডা, চান্দা মুন্ডা, চুনু সাঁওতাল প্রমুখ।
মাকালকান্দি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালে ১৭ আগস্ট সকাল ৯টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌকাযোগে লাখাই উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে আসে। গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। তখন গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় নির্মিত চন্ডীমন্ডপে বিষহরি পূজার আয়োজন চলছিল এবং গ্রামবাসী সেখানে অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গ্রামের বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে চন্ডীমন্ডপের সামনে লাইনে করে দাড় করিয়ে ৮২ থেকে ৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাদের কয়েকজনের নাম হলো অভিনয় দাস, সূর্য কুমার দাস, তরণী কান্ত দাস, গিরিন্দ্র কুমার দাস, ধীরেন্দ্র কুমার দাস, কৃপেন্দ্র সরকার, নকুল চন্দ্র দাস, কর্ণ সরকার, অন্নদাচরণ দাস, সুভাষিণী দাস, সরলা রাণী দাস, খুশি রাণী দাস, অমরি রাণী দাস, মানদা বালা দাস, তমাল রাণী দাস, সুভা রাণী দাস, সুরেন্দ্র দাস, কুমুদিনী দাস, শৈবালিনী দাস, গিরীশ সরকার, শ্যামল বালা দাস, বিধান চন্দ্র দাস প্রমুখ।
নজিপুর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দালাল আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী, আবদুল মছব্বির চৌধুরী ও ফজলুল হক মতওল্ডীর তৎপরতায় পাকিস্তানি বাহিনী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নজিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে গ্রামটিকে ঘেরাও করে গুলি শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে-বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। কিছু লোক হাওরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। এখানে প্রায় ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন কমল চন্দ্র দাস, ষোড়শী ছায়া রাণী দাস, বারীন্দ্র চন্দ্র দাস, সুনীতি বালা দাস, মীনা রাণী দাস, ঝরনা রাণী দাস, মাধুরী রাণী দাস, সুবল চন্দ্র নবশূদ্র, প্রফুল্লীময়ী দাস, গোসাইরাম নবশূদ্র, গবিন্দ্র চন্দ্র নবশূদ্র, বিদ্যাবন নবশূদ্র প্রমুখ।
ননীগোপাল রায়বাড়ি বধ্যভূমি
নৌযোগে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী ১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কৃৃষ্ণপুর গ্রামে আসে। এখানে আসার পর গ্রামটি চারদিকে ঘিরে ফেলে এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এক সময় ননী গোপাল রায়ের বাড়িতে ৩২ জন মুক্তিকামী মানুষকে একত্র করে। তারপর চলে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। এ ঘটনায় প্রায় ২৮ জন শহীদ হন। তাদের মধ্যে কয়েক হলেন ননী গোপাল চক্রবর্তী, সুকুমার সূত্রধর, রামা চরণ রায়, মহেন্দ্র রায়, জয়কুমার রায়, ক্ষিতীশ গোপ, রেবতী মোহন রায় প্রমুখ।
চুনারুঘাট বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজাকারদের সহযোগিতায় চুনারুঘাটে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পটি এখানে ছিল সাত মাস। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করার পর হত্যা করা হতো। এখানে এমনি হত্যার শিকার হন গোছাপাড়া গ্রামের যোগেন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র পাল, যোগেশ শুক্ল বৈদ্য ও তার ছোট ভাই, চান্দপুর চা-বাগানের শ্রমিক নিবারং উরাং, কার্তিক ইয়ামুদসহ আরও তিনজন শ্রমিক। এ ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী চুনারুঘাটের হাতুন্ডা গ্রামের যামিনী মোহনদের বাড়িকে পরিণত করে একটি পতিতালয়ে। সেখানে তাঁর স্ত্রীকে বর্বর পাকিস্তানিরা প্রতিদিন পালাক্রমে ধর্ষণ করত।
শ্রীরামসি বধ্যভূমি
জগন্নাথপুরের শ্রীরামসি গ্রামে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল ৯টায় ৭-৮টি নৌকা বোঝাই হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কয়েকজন রাজাকারসহ শ্রীরামসি গ্রামে আসে। শান্তি কমিটির নাম করে সবাইকে এক জায়গায় আসার আহবান করা হলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি। তারপর সকাল ১০টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রের মুখে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে শ্রীরামসি স্কুল মাঠে নিয়ে আসে। এ মাঠে সবাইকে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, এহিয়া চৌধুরী, সত্যেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল আজিজ, দবির মিয়া, আবদুল মান্নান, সবুজ মিয়া প্রমুখ।
রানীগঞ্জ বাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পাকিস্তানি বাহিনী রানীগঞ্জ বাজার ঘিরে ফেলে এবং বাজারের দুই শতাধিক মানুষকে বেঁধে এক লাইনে দাড় করায়। তারপর তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডে শহীদ হন তছর উদ্দিন, সোনাহর আলী, আলতা মিয়া, মদরিছ উল্লা, ধন মিয়া, মিছির আলী, আবদুল হেকিম, আপিল মাহমুদ, আছাল মিয়া, ছয়েব উদ্দিন, আতাউর রহমান, বোরহান উদ্দিন প্রমুখ।
অবহেলিত শায়েস্তাগঞ্জ বধ্যভূমিঃ
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ রেল জংশনের পাশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার দলিল, বধ্যভূমির যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষন ও মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে না। বধ্যভূমির পাশেই রক্ষণাবেক্ষনের জন্য পৌর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামে একটি কার্যালয় রয়েছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বধ্যভূমিটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীন।
শায়েস্তাগঞ্জের এই বধ্যভূমিটি পাচ্ছে না উপযুক্ত মর্যাদা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিটি রেল লাইন সংলগ্ন হওয়ায় রেল লাইন অতিক্রম করা ছাড়া যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। কিছুদিন পূর্বে শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার ব্যবস্থাপনায় শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ মেইন রোড থেকে বধ্যভূমিতে যাতায়াতের সুবিধার্থে একটি স্বতন্ত্র পাকা সড়ক নির্মাণ করা হলেও সড়কটি সিএনজি অটোরিক্সার দখলে। এ সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচলের কোন পরিবেশ নেই। এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ইউনিট কমান্ডার ও বর্তমান জেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌরপ্রসাদ রায় জানান, বধ্যভূমির পাশর্^বর্তী দিঘীর পাড়ে আমগাছের ছায়ায় সিএনজি স্ট্যান্ডটি স্থানান্তর করা হবে।
সিএনজি স্ট্যান্ড নির্মাণের জন্য সেখানে মাটিও ভরাট করা হয়েছে। অস্থায়ীভাবে বধ্যভূমির এই সড়কটি স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে এই সড়ক সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই।
অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে ফয়জাবাদ বধ্যভূমি
অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে বাহুবলের ফয়জাবাদ বধ্যভূমি। ঝুঁপঝাড়ের আড়ালে পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের এই স্মৃতি স্থাপনাটি। বধ্যভূমির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেলেও তা সংস্কারের নেই কোনো উদ্যোগ। মাঝেমধ্যে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ এখানে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করলেও রক্ষণাবেক্ষণ করছেন না কেউ। উপরে উঠার সিড়িতে রেলিং না থাকায় উপরে উঠতে পারেন না বয়স্করা। একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ছাড়া আর কোন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানও হয় না এখানে।
বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গণহত্যা
’৭১ এর ১৮ আগস্ট। বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গ্রামে চন্ডি মন্দিরে চলছিল পূজার প্রস্তুতি। কেউ সাজাচ্ছিলেন পূজোর থালা। অনেকেই ব্যস্ত ফুল সংগ্রহে। এরই মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। ৪৪ নারীসহ ৭৮ জন নিরপরাধ হিন্দুকে নির্বিচারে হত্যা করে হায়েনার দল। লাশগুলো ভাসিয়ে দেয়া হয় পানিতে।
সেই লাশের মিছিল স্বচক্ষে দেখেছেন মিনতী রাণী পাল। এমনকি মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মিনতীর শিশু বাচ্চাও। হত্যার পর শিশুটিকে ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ভয়াল সেই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিনতি।
একই ঘটনার স্বাক্ষী জয়তারা। আজও বেঁচে আছেন লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতি নিয়ে। জয়তারার তিন বছরের বাচ্চাকে টেনে নিয়ে বুটের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করে হানাদারবাহিনী। গুলি করে হত্যা করা হয় তার মেয়ে, স্বামী ও ভাইকে। লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয় তাকেও। তবে বেঁচে যান ভাগ্যগুণে। ওই দৃশ্য মনে হলে এখনও ঘুমাতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন জয়তারা। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রাননাথ দাস বলেন, সবাই ব্যস্ত ছিল পূজো নিয়ে। সকাল নয়টায় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করে গ্রামে। পাখির মতো মারতে থাকে মানুষ। কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে ভাগ্যগুণে প্রাণে রক্ষা পায়। তবে মেরে ফেলা হয়েছে ৭৮ জনকে।
তিনি বলেন, আমার চোখের সামনে বাবা বোন ফুফুসহ অনেককেই মরতে দেখেছি। কাতরাতে দেখেছি মৃত্যু যন্ত্রণায়। তখন নৌকা থেকে বেরিয়ে আসা রাজাকার ফজলুল হককে আমি পরিচয় দেই আমি মুসলমান। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।
যাযাদি/এসএইচ