চট্টগ্রামে হাজার হাজার ভক্তের অংশগ্রহণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা উৎসব উদযাপিত হয়েছে। এবারের রথযাত্রায় লাখো মানুষ সমাগম ঘটেছে। নানা শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর নেচে গেয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় অংশ নেন। নগরীতে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও শুক্রবার (২৭ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর তিনটি মন্দির থেকে রথযাত্রা বের হয়। এগুলো হলো- প্রায় দু’শ বছরের পুরনো নন্দনকানন তুলসীধাম, নন্দনকানন শ্রী শ্রী রাধামাধব মন্দির এবং প্রবর্তকের শ্রীকৃষ্ণ ইসকন মন্দির।
রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র শাহাদাত হোসেন। এসময় তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ধর্মীয় সম্প্রীতির শহর।
এই শহরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একসঙ্গে বসবাস করেন। এখানে কোনো বিভেদ নেই। এই ঐক্য ধরে রেখে চট্টগ্রামকে একটি গ্রিন ও ক্লিন সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা চাই।’
তিনি বলেন,‘আমি চাই রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সবাই চট্টগ্রামের উন্নয়নে অবদান রাখুক। চট্টগ্রাম আমাদের সবার। পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত নগর গঠনে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠন, এনজিও এবং সাধারণ মানুষকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘বর্তমান করোনা ভ্যারিয়েন্ট আগের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। ডেঙ্গু পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। তাই করোনা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসম্পৃক্ততা এখন সবচেয়ে জরুরি।
সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে এবং নিজ নিজ বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।’
রথযাত্রার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য তুলে ধরে শ্রীমৎ দেবদীপ পুরী মহারাজ বলেন, ‘রথের চাকা আমাদের জীবনে ভক্তির গতি এনে দেয়। এই রথ যেমন সম্মিলিতভাবে টানতে হয়, তেমনই জীবনের ভারও ভাগ করে নিতে হয় সবাইকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের যাত্রা চলতে থাকবে বিশ্বাস আর সাহসে। গুরুই সেই ভরসা দেন, যা রথের মতো জীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হয়। রথযাত্রা আমাদের শেখায়-অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় ভরা জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে।’
কেন্দ্রীয় রথযাত্রা উৎসব উদযাপন কমিটির এ আয়োজনে পৌরহিত্য করেন তুলসীধামের মোহন্ত দেবদীপ পুরী।
রথপরিক্রমা অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন- শীতলপুর লোকনাথ সেবাশ্রমের অধ্যক্ষ গোবিন্দ ব্রহ্মচারী, রথযাত্রা উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিধান ধর ও অর্থ সম্পাদক সুজিত হাজারী, অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরী, স্থপতি প্রণত মিত্র চৌধুরী, যোগেশ্বর চৌধুরী, উত্তম কুমার চক্রবর্তী, অভয়মিত্র মহাশ্মশান পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ প্রিয় পাল, ডা. মনোজ চৌধুরী, কৃষ্ণ কর্মকার, রঞ্জন প্রসাদ দাশগুপ্ত, সার্জেন্ট শান্তময় দাশ, সজল চৌধুরী, চন্দ্রনাথ পাল, ডা. বিবরণ দাশ, প্রদর্শন দেবনাথ, অনুপম দেবনাথ।
কেন্দ্রীয় রথের সাথে মহাশোভাযাত্রা সহকারে হাজারী লেইন শ্রীকৃষ্ণায়ন রথ, পাথরঘাটা জগন্নাথ মন্দিরের রথ, গঙ্গাবাড়ির রথ, গৌর গিরিধারী মন্দিরের রথ, সদরঘাট পার্বতী ফকিরপাড়ার রথ, মাইজপাড়ার রথ, ফিরিঙ্গীবাজার শাহাজীপাড়ার রথ, টেকপাড়ার রথ, এনায়েত বাজার কেদারনাথ তেওয়ারী কলোনির রথ, টাইগারপাস জগন্নাথ সংঘের রথ, পুরাতন কাস্টমস এলাকার রথ, ইপিজেড শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের রথসহ বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের রথগুলো পরিক্রমায় অংশ নেয়। এতে অদ্বৈত-অচ্যুত মিশনের সদস্য, বিভিন্ন মন্দির ও ধর্মীয় সংগঠনের ভক্তরা যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় রথ তুলসীধাম থেকে নিউমার্কেট, লালদীঘির পাড়, আন্দরকিল্লা, চেরাগী পাহাড়, প্রেসক্লাব ঘুরে লাভলেইন সড়ক দিয়ে আবার নন্দনকানন রথের পুকুর পাড় গিয়ে শেষ হয়।
এদিকে তুলসীধামে রথযাত্রা উপলক্ষে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় নামযজ্ঞ, মদনমোহন পূজা, জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলভদ্রের পূজা, বিতরণ করা হয় মহাপ্রসাদ।
বিকেলে নগরীর বৌদ্ধমন্দির মোড় থেকে নন্দনকানন রাধামাধব মন্দিরের রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধন করেন চসিক মেয়র শাহাদাত হোসেন। রথযাত্রা নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আবার নন্দনকাননে গিয়ে শেষ হয়।
এদিকে ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে রথযাত্রা উপলক্ষে এবারও ৯ দিনের উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। শুক্রবার ভোরে মঙ্গল আরতির মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব।
নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর বিকেলে প্রবর্তক মোড় থেকে রথযাত্রা বের হয়। ঘোড়ার বহর, পালকিসহ বিভিন্ন পৌরাণিক সাজ-সজ্জা নিয়ে এতে অংশ নেয় হাজার-হাজার মানুষ। এসময় বাদ্যবাজনা বাজিয়ে লোকজন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
হাজার-হাজার মানুষ সড়কের দুইপাশে দাঁড়িয়ে রথযাত্রার রশি টেনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। নারীরা উলুধ্বনি ও মঙ্গলশাঁখ বাজিয়ে রথযাত্রাকে অভ্যর্থনা জানান।