মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২
কর্মকৌশল সম্পর্কে অন্ধকারে কর্মীরা

সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না বিএনপি

১৩ বছর আগে ক্ষমতা হারানোর পর বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না বিএনপি
সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছে না বিএনপি

হাসান মোলস্না

আন্দোলন, নির্বাচন এবং সংগঠন শক্তিশালী করাসহ কোনো সিদ্ধান্তেই স্থির থাকতে পারছে না বিএনপি। ১৩ বছর আগে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারেনি দলটি। আর গত নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত ফলের পর এর মাত্রা আরও বেড়েছে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সর্বশেষ বিষয়টি এসেছে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়ার ঘোষণায়। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতের কর্মকৌশল সম্পর্কেও নেতাকর্মীরা অন্ধকারে।

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি হয়ে যুক্তরাজ্যে, শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা মামলায় জর্জরিত, সহস্রাধিক নেতাকর্মী হত্যা, খুন, গুমের শিকার হওয়ার পাশাপাশি দল ভাঙনের চেষ্টাও চলছে ক্রমাগত। সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই দফা ব্যর্থতার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনে চরম ফল বিপর্যয়ের পর এখন দলের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কোন পরিকল্পনায় তা বাস্তবায়ন হবে সেটা ভেবে দেখা হচ্ছে না। সঙ্গত কারণে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হচ্ছে পরে পরিস্থিতি ও কর্মীদের চাপে তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন নেতারা।

দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের এক নেতা বলেন, শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন যতটা সহজ ছিল এখন তা ততটাই কঠিন। শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে একই রকম 'চেইন অব কমান্ড' আশা করা যৌক্তিক নয়। তাই আন্দোলন, সংগঠন পুনর্গঠন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে এক ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কর্মীদের চাপে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, গত ৫ জুলাই স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত হয় দলীয় প্রতীকে নয়; স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে দলীয় প্রার্থীরা অংশ নেবেন। কিন্তু এ দুই মাসের মধ্যে কর্মীদের চাপসহ আরও ২/১টি কারণে গত শনিবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর প্রায় সব সিদ্ধান্তই পরিবর্তন করেছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ওই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দেয়। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে আন্দোলনে গেলে আবারও ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় এক পর্যায়ে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। এরপর দলের নির্বাচিত ৬ এমপির সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসে দলটি। দলের নেতারা সংসদে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে দলীয় এমপিরা সংসদে যোগ দেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর

বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ কারণে উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ৩ শতাধিক তৃণমূল নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে বিভিন্ন মহল ও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপে বিএনপি সব নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর বহিষ্কৃত নেতাদের বহিষ্কারাদেশও প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া সর্বস্তরে দল পুনর্গঠন শুরু করে দল গুছিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নেয় বিএনপি। কিন্তু সব ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের একই পদ্ধতি অনুসরণ না করায় দল গোছাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে বিএনপি। সিদ্ধান্ত ছিল, দলের জেলা-উপজেলা কমিটি পুনর্গঠনের পর জাতীয় কাউন্সিল করার। কিন্তু কিছু জেলা ও উপজেলা কমিটি এবং ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে দু-একটির কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে বড় রকমের বাধা পায় বিএনপি। এরপর সর্বস্তরে দল গোছানোর কাজও স্থবির হয়ে পড়ে। এ কারণে জাতীয় কাউন্সিলের দিনক্ষণের পরিকল্পনাও করা যাচ্ছে না।

নির্বাচন আর সংগঠন পুনর্গঠনের বিষয়ে বিএনপি যেমন স্থির সিদ্ধান্তে থাকতে পারেনি তেমনি আন্দোলনের বিষয়ে একই অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়। এ পর্যন্ত স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করার। কিন্তু আন্দোলন কীভাবে হবে সেই পরিকল্পনা না করে সিদ্ধান্ত নেয়ায় এখন পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে নামতে পারেনি। এছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কূটনীতিকদের অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও তা পরিবর্তন করে বিএনপি।

সব মিলিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যত সিদ্ধান্তই নিয়েছে, কোনো সিদ্ধান্তেই অটল থাকতে পারেনি দলটি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দল থেকে সরকারের কাছে শর্ত দেয়া হয়েছিল খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এছাড়া জোটের রাজনীতির ইসু্যতে এক সিদ্ধান্তে থাকতে পারেনি বিএনপি। একবার জোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও আরেকবার সিদ্ধান্ত হয় একাই আন্দোলনের মাঠে থাকার। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি।

উপজেলা নির্বাচনের ইসু্যসহ বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজনীতিতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। আর উপজেলা নির্বাচনের স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ না নেয়ার আগের যে সিদ্ধান্ত, সেটি রিভিউ করার কারণ হচ্ছে, স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অংশগ্রহণ করতে চান। ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব নির্বাচনও হবে দলীয় প্রতীকেই। সেখানে নৌকা প্রতীকও থাকবে।  সে ক্ষেত্রে বিএনপি প্রার্থীদের ধানের শীষের প্রতীক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামীতে উপজেলা ও মেয়র নির্বাচনে প্রার্থীরা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে