শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি, সভ্যতা ও অর্থনীতির প্রতীক-সাদা স্বর্ণ (তুলা)

ড. মোঃ তাসদিকুর রহমান সনেট
  ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫১
সংস্কৃতি, সভ্যতা ও অর্থনীতির প্রতীক-সাদা স্বর্ণ (তুলা)

কবির ভাষায় “তুমি কার্পাস, তুমি ইতিহাস

তুমি শুভ্রতার প্রতীক

তুমি এনেছ শিল্প

তুমি দিয়েছ মানব অঙ্গে দ্যুতি।

তুলা সমগ্র বিশ্বে একটি অর্থকরী ফসল। তুলা সাদা স্বর্ণ নামে পরিচিত। তুলার প্রতিশব্দ অনেক-যেমন কর্মসংস্থান, অর্থনীতি পবিত্রতা, বস্ত্র। বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্পের কাঁচামালের পাটের পরেই তুলার অবস্থান। সাধারণত তুলা চাষের জন্য উচু জমির প্রয়োজন। আমাদের দেশের উৎপাদিত তুলা আন্তর্জাতিক মানের যা আপল্যান্ড কটন বা সমভূমির তুলা হিসাবে পরিচিত।

পৃথিবীতে বর্তমানে যে চার প্রজাতির তুলা চাষ করা হয় তার মধ্যে Gossypium hirsutum যা আমেরিকান কটন বা সমভূমির বা আপল্যান্ড কটন নামে পরিচিত। এছাড়া মিশরে লম্বা আঁশযু্ক্ত Gossypium barbadense, মেডিটারিয়ান অঞ্চলে Gossypium herbaceum এবং আমাদের উপমহাদেশের Gossypium arboreum অন্যতম। আমাদের দেশে বর্তমানে যে সকল প্রচলিত ফসল চাষ করা হয় তার সবগুলিই ছিল বন্য প্রকৃতির, যুগ যুগ ধরে Domestication করে আজকে এই অবস্থায় আনা হয়েছে। তুলাও সেরকম একটি ফসল। এটি ছিল বহুবর্ষজীবি বর্তমানে বর্ষজীবি। জাতভেদে এটির উৎপাদনকাল ৬ থেকে ৭ মাস। তবে জমিতে রেখে দিলে আখের মুড়ি ফসলের মত ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির মাধ্যমে আবার ফুল ও বল দেয়। তুলার ইতিহাস অনেক পুরাতন। খনার বচনে অন্যান্য ফসলের সাথে কার্পাসের কথা বলা আছে।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে পৃথিবীতে তুলার চাষ শুরু হয়। আর্যদের যুগ থেকে বৃটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, ঘরে ঘরে চরকায় সূতো হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাতো, বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় ও অন্যান্য সুতী বস্ত্র সমগ্র ইউরোপে রপ্তানী হতো, বিনিময়ে এসেছে বহু মূল্যবান ধাতু। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের কাপড় বাংলাদেশী কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারতো না বলে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশী কাপড় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

বৃটিশ আমলে ইংরেজদের উপনিবেশিক নীতির ফলে কার্পাস চাষ ও তাঁত শিল্প বন্ধ হলো। কার্পাস চাষের পরিবর্তে এদেশের কৃষকদের বাধ্য করা হলো নীল চাষের আর আমাদের কার্পাস স্থানান্তরিত হলো ইংরেজদের নির্ভরযোগ্য উপনিবেশ আমেরিকায়।

খনার বচনে তুলা চাষের কথা বলা হয়েছে:

“ষোল চাষে মূলা। তার অর্ধেক তুলা”

তার অর্ধেক ধান।। বিনা চাষে পান”

যদিও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এখন আর আট চাষের প্রয়োজন পড়েনা। দুই তিনটি চাষ দিয়েই তুলা চাষ করা যায়। আবার বৈরী আবহাওয়ায় বিনাচাষে চারা রোপন পদ্ধতি অনুসরণ করে তুলা চাষ করা হয় বর্তমানে।

আরও একটি বচন রয়েছে-

আদম যখন চষতো মাটি, হাওয়া বুনতো সুত।

তখন ভবে ভদ্র ছিল, কোন সে বাপের পুত।

এ থেকে অনুমান করা যায় সৃষ্টির শুরু থেকেই আঁশ জাতীয় ফসলের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তুলার গুরুত্ব অপরিসীম। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদার উপর ভিত্তি করে প্রতিবছর ৮০ থেকে ৯০ লাখ বেল তুলা আমদানী করতে হয় যাতে খরচ হয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা।

তবে আমাদের সতের কোটি মানুষের যে বস্ত্রের প্রয়োজন হয় তার ১৫-২০% তুলা আমাদের দেশেই উৎপাদিত হয়ে থাকে। বর্তমান মৌসুমে সারাদেশে ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে তুলাচাষ করা হয়েছে। এ থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ আটাশ হাজার বেল যার বাজার মূল্য প্রায় ছয়শত কোটি টাকা। বর্তমানে তুলা উন্নয় বোর্ড এবং বেসরকারী বীজ কোম্পানি যৌথভাবে চাষী পর্যায়ে গুনগত মান সম্পন্ন তুলাবীজ সরবরাহ করে থাকে। ইতিমধ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড বিটি তুলার দুটি জাত অবমুক্ত করেছে যা এবছর চাষী পর্যায়ে ট্রায়ালে আছে। প্রতিটি জাতের বীজের উৎপাদনশীলতা ২৫ থেকে ৩০ মণ। তবে আমাদের দেশের আবহাওয়া জনিত কারণে এর উৎপাদনশীলতা গড়ে ১৪-১৫ মণ বিঘাপ্রতি। সঠিক পদ্বতি ও অনুকূল আবহাওয়ায় একর প্রতি এর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব।

একসময় তুলার গড় ফলন ছিল বিঘাপ্রতি ৪-৫ মণ-২০০৮ সালের পর থেকে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এ বছর তুলার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯০০ টাকা। বিঘা প্রতি খরচ ১৪-১৫ হাজার টাকা। নীট লাভ ছয় মাসে দাঁড়ায় ৪৩,৫০০ টাকা। আমাদের দেশে টেক্সটাইল সেক্টরে কর্মরত জনবলের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষাধিক এর ভেতর ৮০% মহিলা। জিডিপিতে এই সেক্টরের অবদান ১৩%। রপ্তানী আয়ের ৮৪% আসে টেক্সটাইল সম্পর্কিত পণ্য থেকে।

১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীণ করার পর তুলা চাষ সম্প্রসারণের কথা চিন্তা করে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠণ করেন। তৎকালীন পেশাক শিল্পের এই বাঁচামালের পুরোটাই পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত হত। বর্তমানে ৪টি রিজিয়নাল ও ১৩ টি জোনাল কার্যালয়ের মাধ্যমে উনচল্লিশটি জেলায় তুলাচাষ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। গবেষণা কার্যক্রমের জন্য রয়েছে উপকেন্দ্রসহ ৭টি খামার। তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলাচাষ সম্প্রসারণ, গবেষণা, বীজ বিতরণ, জিনিং ও বাজারজাতকরণে সহায়তা ও স্বল্প পরসরে ‍ঋণ দান করে থাকে।

বর্তমানে সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ঢাকাতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একটি নিজস্বভবন দান করেছেন। এই ভবনে ভবিষ্যতে আধুনিক মানের বায়োটেনোলজিসহ ল্যাব স্থাপনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রসারণ ও গবেষণা কার্যক্রমকে জোড়দার করার জন্য রিভিজিট বাস্তবায়নের পথে। তুলা উন্নয়ন বোর্ড দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি এবং স্টেকহোল্ডারগণের সাথে একযোগে কর্মসম্পাদন করছে। ২০৪১ সালের মধ্যে খাদ্যশস্যের ব্যঘাত না করে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের চাহিদার ২০-২৫% তুলা বাংলাদেশে উৎপাদিত হবে যার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, তৈরী হবে কর্মসংস্থান ও নিজেরা হব স্বাবলম্বী।

লেখক: ড. মোঃ তাসদিকুর রহমান সনেট সাধারণ সম্পাদক, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, ঢাকা মেট্রোপলিটন ও বীজ উৎপাদন বিশেষজ্ঞ, তুলা উন্নয়ন বোর্ড।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে