শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতারির দাম আকাশ ছোঁয়া

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৩ মার্চ ২০২৪, ১০:০৭
ছবি-সংগৃহিত

প্রথম রোজাতে মুখোরোচক কিছু খাবার দিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে চান বীমা কর্মকর্তা নেসারুল হক ও তবিবুর রহমান। তাই দুপুর গড়াতেই দুই সহকর্মী ছুটে গেছেন পুরান ঢাকার চকবাজারে ঐতিহ্যবাহী ইফতার কিনতে। তবে দাম শুনে তাদের চোখ ছানাবড়া। প্রতিটি আইটেমের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। স্পেশাল হালিমসহ অন্যান্য আইটেমগুলোর দাম দ্বিগুণেরও বেশি। বেশিরভাগ ইফতার সামগ্রী ছোট হতে হতে অদ্ভুত আকার নিয়েছে।

শুধু চকবাজারেই নয়, খিলগাঁও, ধানমণ্ডি, বনানী, গুলশান, মতিঝিল, পল্টন ও বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীর প্রায় এক ডজন এলাকার ইফতার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবখানেই একই অবস্থা। ইফতারির প্রতিটি আইটেমের দাম আকাশ ছোঁয়া। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দেশি ফলের দামও। শেষ সময়ে নিম্নমানের খেজুরের দাম বেঁধে দেওয়া হলেও তার সামান্য প্রভাব পড়েনি কোনো বাজারে। ফলে প্রথম রোজার দিন বিকাল হতেই ভোজনবিলাসী লাখ লাখ মানুষ ইফতার কিনতে পাড়ামহল্লার ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টে হুমড়ি খেয়ে পড়লেও তাদের বড় একটি অংশকে হতাশ হয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। তবে কেউ কেউ ৫/৬ আইটেমের ইফতার কেনার টাকা দিয়ে ২/৩ আইটেম কিনে খ্যান্ত হয়েছেন।

মগবাজারের ওয়ারলেস কলোনির সামনের ফুটপাতে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসা দোকানি জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত বছর রমজানে পেঁয়াজু ও বড়া প্রতি পিস ৫ টাকায় বেচলেও এবছর ১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। বেগুনি ও আলুর চপের দাম আগের চেয়ে প্রতি পিসে ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৫ টাকায় বেচতে হচ্ছে। গত বছর রমজানে যে পরিমাণ ছোলা ভুনা ২০ টাকায় বেচেছেন, এবার তা ৩০ টাকা। জিলাপির দাম কেজিতে ৭০ টাকা বাড়িয়ে ২৫০ টাকায় বেচতে হচ্ছে।

তবে খিলগাঁওয়ের শহীদ বাকী সড়কের মধ্যম মানের রেস্টুরেন্টগুলোতে মাঝারি আকারের প্রতি পিস পেঁয়াজু ও বড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। বেগুনি-আলুর চপ ২০ টাকা, গরুর শিক কাবাব প্রতি পিস আড়াইশ’ থেকে ৩শ’ টাকা, চিকেন বটি কাবাব ১৮০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। মাংসের টিক্কা প্রতি পিসে দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ডিমের চপ ৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। রেশমি জিলাপি ও বোম্বে জিলাপি মান ভেদে ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর আধা কেজি হালিমের বাটি সাড়ে তিনশ’ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা এক লাফে ৫শ’ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। একই পরিমাণ খাশির হালিমের দাম সাড়ে ছয়শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। দই বড়ার দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বেইলি রোড ও খিলগাঁওয়ের অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে সাধারণ ইফতারি খেতে গিয়ে মানুষকে রীতিমতো ভিমড়ি খেতে হয়েছে। গত বছর রমজানে সফট ড্রিংকসসহ ইফতারির যে প্যাকেজ বিক্রি হয়েছে ৭ থেকে ৮শ’ টাকায়। এবার একই প্যাকেজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা।

এদিকে ফলের দোকানগুলোতে কলা, বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, আপেল, বড়ই, পেয়ারা, নাশপতি, বেদানা, আঙ্গুর ও বিভিন্ন ধরনের খেজুর চড়া দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগেও বড়ই ও পেয়ারাসহ যেসব দেশি ফল সর্বোচ্চ একশ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, রোজার শুরুতেই তা এক লাফে বেড়ে দেড়শ’ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ৬০ টাকা ডজন দরে বিক্রি হওয়া চাপা কলা ৮০ থেকে ৯০ টাকায় এবং ৮০ টাকা ডজনের সাগর কলা ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক’দিন আগে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া আনারসের দাম হাঁকছে ১২০ টাকা। আঙ্গুরের দাম মান ভেদে কেজি প্রতি ৭০/৮০ টাকা এবং আপেলের দাম কেজি প্রতি ৫০/৬০ টাকা বেড়েছে। দেশি তরমুজের দামও এবার আকাশ ছোঁয়া। ছোট সাইজের তরমুজ কিনতেও ন্যূনতম দেড়শ’ টাকা গুনতে হয়েছে। আমদানি করা ফলের মধ্যে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়। অথচ গত বছর এ সময় মাল্টার কেজি ছিল ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। একইভাবে নাশপাতি কেজিতে ৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৯০ টাকা। ১৯০ থেকে ২২০ টাকার কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা। সৌদি আরবের খেজুর মেডজুল, মাবরুম, আজওয়া ও মরিয়ম। কয়েকদিনের ব্যবধানে এসব খেজুরের দাম কেজিতে ২০০-৩০০ টাকা বেড়েছে। জাম্বো মেডজুল মানভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০, সাধারণ মেডজুল ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০, মাবরুম খেজুর ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ ও আজওয়া খেজুর মানভেদে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ইফতারির অন্যতম আইটেম ইসবগুলের ভুসি। এ পানীয় দিয়ে রোজা ভাঙতে পছন্দ করেন অধিকাংশ রোজাদাররা। তবে এবার রোজার আগেই প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে শরবতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসির। বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি মানভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা এক মাস আগে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিল। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছয় মাস আগে ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা।

বেগুন, শসা ও কাঁচা মরিচের বাজারে রীতিমতো অরাজকতা চলছে। রাজধানীর সব বাজারে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে এই পণ্যগুলোর দাম। সকালে যে শসা বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায় বিকালে সেটির দাম ছুঁয়েছে একশ’ টাকা। বেগুনের বাজারেও দামের পার্থক্য ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। একেক বাজারে আবার একেক দামে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য।

এদিকে শুধু দোকান বা রেস্টুরেন্টের ইফতারির সামগ্রির দামই বাড়েনি, বাসায় বানানো ইফতারির খরচও বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। যা নিম্নমধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। উচ্চমূল্যের ইফতার সামগ্রি কিনতে না পেরে অনেকে শুধু চিড়া-গুড় কিংবা চিড়া-দই দিয়ে ইফতার সেরেছেন। নিম্নবিত্ত অনেক পরিবার পানি খেয়ে রোজা ভেঙে কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার খেয়েছেন।

রামপুরার বাসিন্দা আয়েশা খানম জানান, সপ্তাহখানেক আগে যে লেবু ৫০ থেকে ৬০ টাকা ডজন দরে কেনা গেছে, রোজা শুরুর পর তা বিক্রি হচ্ছে দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা। চিনির দাম গত বছর রমজানে ছিল প্রতিকেজি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। সে চিনির দাম এখন ঠেকেছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। তাই এক গ্লাস ঠাণ্ডা লেবু-চিনির শরবত খেতেও খরচ হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। গত বছর আধাকেজি মিষ্টি দই অনায়াসে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় কেনা গেলেও এবার তা দাম বেড়ে হয়েছে দেড়শ’ থেকে ১শ’ ৮০ টাকা। তাই চিড়া-দই দিয়ে ইফতার সারতেও আগের চেয়ে অন্ততঃ ৪০ শতাংশ বেশি খরচ হচ্ছে।

আয়েশা খানম বলেন, আগে গরমের সময় রোজা হলে অধিকাংশ বাসা-বাড়িতে ইফতারিতে বেলের শরবত অনেকটা নিয়মিত আইটেম ছিল। তবে এবার বেলের আকাশচুম্বি দাম হওয়ায় তা নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একই অবস্থা তরমুজেরও। সহজলভ্য এ ফলটিও এবার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। সুন্নতি খাবার খেজুরও এখন ইফতারি বিলাসী আইটেম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা আরমান মোল্লা জানান, তার ৬ সদস্যের পরিবারের প্রতিদিনের ইফতারির খরচ ছিল ৫শ’ টাকা। অথচ প্রথম রোজার দিন ৮শ’ টাকার ইফতারিতেও কারো মন ভরেনি। ইফতারির দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে মুখোরোচক খাবার দিয়ে ইফতারি করা এখন রীতিমতো বিলাসিতা- যোগ করেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, ইফতারির দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে মধ্যবিত্তদের সাধারণ খাবার কাটছাঁট করতে হবে। এবার শুধু রোজায় ইফতার সারতেই ব্যয় বেড়ে যাবে অন্তত ৪০ শতাংশ। ইফতার সারতে চারজনের একটি পরিবারে প্রায় সাড়ে চার কেজি চিনি খরচ হতে পারে। এতে ব্যয় হবে ৬৩০ টাকা। ভাজাপোড়ায় অন্তত পাঁচ লিটার তেল প্রয়োজন হয়, খরচ হবে ন্যূনতম ৮০০ টাকা। এর বাইরে ছোলা, ডাল, বেসন, পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ ইফতারির ভাজাপোড়ার অন্যান্য পণ্যে আরও প্রায় ৪ হাজার টাকা ব্যয় হবে। ফল কিনতে ব্যয় হবে প্রায় ৩ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে চারজনের একটি পরিবারের ইফতার সারতে রমজান মাসে ন্যূনতম খরচ হতে পারে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা, যা গত বছর ছিল ৬ হাজার টাকার কম।

এদিকে রমজান ঘিরে শুধু ইফতারিরই নয়, নিত্য খাদ্যপণ্যের দামও বেশখানিকটা বেড়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণে যা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ; অর্থাৎ খাবারের যে পণ্য আগের বছরের জানুয়ারিতে ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, গত জানুয়ারিতে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৫৮ পয়সায়। অথচ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বাড়েনি। ফলে রমজানের শুরুতেই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।

এদিকে বাজার পর্যবেক্ষকরা মূল্যস্ফীতির জন্য সরকারের ভুল নীতি, সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা এবং বাজার তদারকিতে ব্যর্থতার কথা বললেও ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা এজন্য মূলত ডলার সংকটকে দায়ী করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। তবে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকার অবমূল্যায়ন ৪০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা বলা হলেও কোনো আমদানিকারকই এই দরে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলসিতে বেশি দামে ডলার কিনতে হয় এবং অতিরিক্ত দাম নগদে পরিশোধ করেন আমদানিকারকরা। দুই বছরের মধ্যে এখন সুদের হারও বেশি। আমদানি পণ্যের দাম বাড়াতে এটিও বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও ভোক্তাদের অভিযোগ, এসব ছাপিয়ে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এখন সবচেয়ে বেশি। যার কারণেই মূলত রমজানের বাজার তেতে উঠেছে। পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট এখন এতটাই শক্তিশালী যে উৎপাদন মৌসুমেও পেঁয়াজ তিন গুণের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এবার সব রেকর্ড ভেঙে শীতকালীন সবজিও উচ্চমূল্যে কিনতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোজায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন তারা।

দ্যা গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় বলা হয়, রমজানে ৮৩ শতাংশ পরিবার তাদের খাদ্যগ্রহণের অভ্যাস পরিবর্তন করে। রমজানে খাদ্যের খরচ খাদ্যের বার্ষিক ব্যয়ের ১৫ শতাংশ হয়। তবে এবার এ খরচে ইফতার করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে