বাবা ভারতীয় বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরের বাসিন্দা। মা রাশিয়ান। দাম্পত্যকলহের জেরে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দু’জনে। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চার অধিকার কার, তার মীমাংসা করতে গিয়ে কার্যত হিমশিম খেতে হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টকে। শেষমেশ শীর্ষ আদালতকেই বলে দিতে হচ্ছে, সপ্তাহের কোন দিন ছেলে মায়ের কাছে থাকবে, আর কোন দিন বাবার কাছে! ঘড়ি ধরে ঠিক কখন সন্তানের হাতবদল হবে, তা-ও বলে দিতে হল সর্বোচ্চ আদালতকে।
গত দু’বছর ধরে চলতে থাকা স্বামী-স্ত্রীর ওই আইনি লড়াই দিনে দিনে যে ভাবে জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, তা দেখে একে ‘পিকিউলিয়ার সিচুয়েশন’ (অদ্ভুত পরিস্থিতি) বলে মন্তব্যও করেছে শীর্ষ আদালত। প্রথম দিনের শুনানিতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে মামলায় যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল বিচারপতি সূর্য কান্তের বেঞ্চে। পরে মামলায় যুক্ত করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারকেও। পাশাপাশি, বিদেশ মন্ত্রককেও এই মামলায় নজর রাখতে বলেছে আদালত।
ছয় বছরের সন্তানের অধিকার দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন মা। নাম মারিয়া বসু (নাম পরিবর্তিত)। রাশিয়ার ওই নাগরিক আদালতে জানান, তিনি ২০১৯ সাল থেকে এক্স-১ ভিসা নিয়ে ভারতে রয়েছেন। এখানেই বিয়ে হয় চন্দননগরের সৌরভ বসু (নাম পরিবর্তিত)-র সঙ্গে। ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বরে তাঁদের পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু এখন কিছু কারণে দু’জনে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মারিয়া ছেলেকে নিয়ে রাশিয়া চলে যেতে চাওয়ায় বিবাদ বাধে দু’জনের মধ্যে। স্ত্রীর অভিযোগ, চন্দননগরের বাড়িতে ছেলেকে আটকে রেখেছিলেন তাঁর স্বামী। তাই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
মায়ের আবেদনের পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সঙ্গেই কথা বলে আদালত। পরে বিষয়টি শীর্ষ আদালতের মিডিয়েশন সেন্টারে (মধ্যস্থতা বিভাগ) পাঠানো হয়। মধ্যস্থতাকারী প্রাথমিক ভাবে সন্তানের জন্য স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। এর পরেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, মামলার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত দিল্লির বঙ্গভবনে দু’টি আলাদা ঘরে থাকবেন স্বামী-স্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেসিডেন্ট কমিশনারকে তিন সপ্তাহের মধ্যে তার ব্যবস্থা করতে বলে আদালত। বিচারপতি কান্তের বেঞ্চ জানায়, চার দিনের মধ্যে ছেলেকে চন্দননগরের বাড়ি থেকে দিল্লির বঙ্গভবনে নিয়ে যাবেন স্বামী। সেখানে মা-বাবার সঙ্গে থাকবে শিশুটি। রাতে সে মায়ের কাছে ঘুমোবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া সন্তানকে দিল্লির বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না বাবা।
কিন্তু পরিস্থিতি আরও জটিল হয় বঙ্গভবনে। সেখানেওঝামেলা হওয়ায় দু’জনেই আদালতে জানান, তাঁরা একসঙ্গে বঙ্গভবনে থাকতে চান না। মধ্যস্থতা বিভাগও জানায়, শিশুটি তার মায়ের কাছে থাকতে চাইছে। এর পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে স্বামী-স্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি, দু’জনকে দিল্লির এমসের এক মনোবিদের কাছেও যাওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি, বিচারপতি কান্তের বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, শিশুটি বড় হচ্ছে। তার স্কুলে যাওয়া দরকার। নির্দেশ, খেলার মাঠ আছে এ রকম স্কুলে তাকে ভর্তি করতে হবে। সেইমতো শিশুটিকে দিল্লির একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করানো হয়।
অন্য দিকে, মনোবিদের সঙ্গে আলোচনার পরেও স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মেটেনি। ওই পরিস্থিতিতে আদালত সিদ্ধান্ত নেয়, স্বামী-স্ত্রী আলাদাই থাকবেন। কিন্তু সন্তান যাতে দু’জনের সঙ্গেই থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সেইমতো তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেয় আদালত। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শুধু মায়ের কাছেই থাকবে ছেলে। তবে রাতের খাবার বাবা খাওয়াতে পারবেন। আবার রাতে খাবার পর ছেলে মায়ের কাছে থাকবে। আবার সকাল ৭টায় ছেলেকে বাবার হাতে তুলে দিতে হবে। তিনিই ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাবেন।
তাতেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। শেষমেশ চলতি বছর ২২ মে-র শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয়, সপ্তাহে তিন দিন করে মা-বাবা দু’জনের কাছেই থাকবে শিশুটি। আদালতের পর্যবেক্ষণ, মা হিসাবে রাশিয়ার ওই নাগরিক সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ দেখিয়েছেন। আবার বাবার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। অফিসে না-গিয়ে বাড়ি থেকে কাজ করেছেন সন্তানের জন্য। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেও নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেননি তিনি।
মধ্যস্থতাকারী লাগাতার চেষ্টা করেও মীমাংসা করতে না-পারায় শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টকেই বলে দিতে হল, সপ্তাহে কোন কোন দিন ছেলেটি তার মায়ের কাছে থাকবে আর কোন কোন দিন বাবার কাছে। শীর্ষ আদালত জানায়, প্রতি সপ্তাহে সোম, মঙ্গল এবং বুধবার মায়ের কাছে থাকবে সন্তান। ওই তিন দিন তাঁকে সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে। ছেলের খাওয়াদাওয়া, তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, সব দায়িত্বই মায়ের। তিন দিন পরে তাকে বাবার কাছে পাঠাতে হবে। তার আগে নিশ্চিত করতে হবে সন্তান সুস্থ রয়েছে।
আদালত জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে মা ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দেবেন। স্কুল শেষ হওয়ার পর সন্তানের দায়িত্ব থাকবে বাবার উপর। সোমবার সকাল পর্যন্ত সে বাবার কাছেই থাকবে। মায়ের মতো বাবাও সোমবার সকালে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেবেন। স্কুল শেষে আবার সন্তানের দায়িত্ব নেবেন মা। পাশাপাশিই আদালতের নির্দেশ, যে ক’দিন সন্তান তাঁর কাছে থাকবে, সেই সময়ে মা বাইরের কাউকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দিতে পারবেন না। এমনকি রাশিয়ার কোনও ব্যক্তিও নন। এই নির্দেশের লঙ্ঘন হলে আদালত কঠোর পদক্ষেপ করবে।
দিল্লির লাজপত নগর এবং ডিফেন্স কলোনি থানাকেও মা-বাবার উপর নজর রাখতে বলেছে আদালত। কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে মায়ের বাড়িতে মহিলা পুলিশকর্মী মোতায়েন করতেও বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, ফুটবল অ্যাকাডেমিতে শিশুটির প্রশিক্ষণে যাতে কোনও ভাবে বাধা তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আদালত পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত মায়ের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতেও বিদেশ মন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
দিও সৌরভ আগেই আদালতে জানিয়েছিলেন, তাঁর অফিস কলকাতায়। তাই সেখানে ফিরে যেতে হবে তাঁকে। সে ক্ষেত্রে মারিয়াকে কলকাতায় কোনও নিরাপদ জায়গায় রাখা যায় কি না, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল আদালত। এমন জায়গা, যেখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের পক্ষেই সন্তানের দেখাশোনা করতে সুবিধা হবে।
দিল্লিতে রাশিয়ার দূতাবাসের কাছেও সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল, মারিয়াকে ভারতে কোনও কাজ দেওয়া সম্ভব কি না। এ বিষয়ে রাশিয়ার দূতাবাসের আধিকারিক আদালতে জানিয়েছিলেন, পর্যটন ভিসায় ভারতে এসেছেন, এমন কোনও নাগরিককে অস্থায়ী চাকরি দেওয়া সম্ভব নয় তাঁদের পক্ষে। মারিয়াকে শুধু আইনি সাহায্যই করা যেতে পারে। তাঁকে যদি সন্তান-সহ রাশিয়া যাওয়ার অনুমতি দেয় আদালত, তা হলে তাঁরা সেই নির্দেশটুকু পালন করবেন। তাঁদের পক্ষে মারিয়ার জন্য কলকাতায় থাকার বন্দোবস্ত করাও সম্ভব নয় বলেও জানায় রাশিয়ার দূতাবাস। এর পরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতে জানায়, সল্টলেকে ইনস্পেকশন বাংলোয় মারিয়া এবং তাঁর সন্তানকে রাখা যেতে পারে। এখন দেখার বিষয়টি কোন দিকে গড়ায়। মামলার পরবর্তী শুনানি চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ে।