মার্কিন পারস্পরিক শুল্কের চাপ সামলাতে ১৩৫ পণ্যের শুল্ক কমানো হবে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ৩১টি শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের পাশাপাশি আয়করের আওতায় আনা হবে আইটি ব্যবসাকে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জুলাই আন্দোলনের আহত সরকারি গেজেটভুক্ত জুলাইযোদ্ধাদের আয়করে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। বাড়ানো হবে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা। এমন পরিকল্পনা নিয়েই আগামী অর্থবছরের (২০২৫–২৬) বাজেট সাজানো হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি এবং মার্কিন প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্ক সামলাতে ১৩৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক এবং ৩০০-রও বেশি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হচ্ছে।
আমদানি–রপ্তানিকারকদের স্বস্তি দিতে বাজেটে ভুল এইচএস কোড ঘোষণা বা মিথ্যা ঘোষণার জরিমানা কমানো হচ্ছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কখনো ভুলবশত বা অজ্ঞতাবশত এইচএস কোডের ভুলের কারণে মিথ্যা ঘোষণা হয়।
গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা এইচএস কোডের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সভা–সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহল থেকে অভিযোগ করায় আগামী বাজেটে এটি মিথ্যা ঘোষণার সমপরিমাণ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। বর্তমানে মিথ্যা ঘোষণার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ জরিমানার বিধান আছে।
নতুন অর্থবছরের শুল্ক স্তর একটি বাড়িয়ে ৭টি (০%, ১%, ৩%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%) করা হতে পারে। মূলত দেশে উৎপাদিত হয় না, এমন মধ্যবর্তী এবং শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের শুল্ক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে খাদ্যদ্রব্য, সার, বীজ, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, তুলাসহ শিল্পের কাঁচামালের শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক স্তর ১২টি থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করা হচ্ছে। বর্তমানে ৬ স্তরের (০%, ১%, ৫%, ১০%, ১৫%, ২৫%) শুল্ক কাঠামো বিদ্যমান আছে।
এদিকে আইএমএফের পরামর্শে শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। শিল্পখাতগুলো হচ্ছে— একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট ও রেডিও ফার্মাসিউটিক্যাল, কৃষিযন্ত্রপাতি, ব্যারিয়ার কন্ট্রাসেপটিভ ও রাবার ল্যাটেক্স, ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক উপাদান (রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ট্রানজিস্টর, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও মাল্টিলেয়ার পিসিবি), বাইসাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ, বায়োফার্টিলাইজার, বায়োটেকনোলজি ভিত্তিক কৃষিপণ্য, বয়লারের খুচরা যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, আসবাবপত্র, হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইনডাকশন কুকার, ওয়াটার ফিল্টার), কীটনাশক ও বালাইনাশক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, এলইডি টিভি, ফলমূল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ, মোবাইল ফোন, পেট্রোকেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং, টেক্সটাইল মেশিনারি, টিস্যু গ্রাফটিং, খেলনা উৎপাদন, টায়ার ম্যানুফ্যাকচারিং, ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার, ম্যান–মেড ফাইবার উৎপাদন, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, রোবোটিক্স ডিজাইন, এআই ভিত্তিক সিস্টেম ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিং, ন্যানোটেকনোলজি–ভিত্তিক পণ্য ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এয়ারক্রাফট হেভি মেইনটেন্যান্স সার্ভিস ও খুচরা যন্ত্রাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং।
এদিকে সাধারণ ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হতে পারে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জুলাইযোদ্ধাদের আয়কর সীমায় ছাড় দিতে যাচ্ছে সরকার। ২০২৬–২৭ ও ২০২৭–২৮ অর্থবছরের আয়ের জন্য এই সীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ওপর নতুন সীমা অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হবে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত এক হাজার ৪০১ জনকে ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাইযোদ্ধাদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে উন্নত চিকিৎসা ও জীবনযাপনে কী সুযোগ–সুবিধা পাবেন, তা গেজেটে উল্লেখ করা হয়। যারা চিকিৎসার পর বর্তমানে সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এমন ১০ হাজার ৬৪৮ জনকে আরেকটি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। তবে তাদের তালিকা এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে মধ্যবিত্তের পাশাপাশি উচ্চবিত্তের ওপর কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এ জন্য করের স্লাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিদ্যমান কর কাঠামোয় একজন উচ্চবিত্তের বার্ষিক আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিক্রম করলে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এতে উচ্চবিত্তদের বাড়তি কর দিতে হবে।
এ ছাড়া আইটি ব্যবসা হতে উদ্ভূত আয়কে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ফলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, এনটিটিএন, অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, গ্রাফিক ডিজাইন, ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স, গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস, সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভার্সন ও ডিজিটাল আর্কাইভিং, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও আইটি ফ্রিল্যান্সিং আয়ের ওপর আয়কর দিতে হবে। আগে এসব আইটি খাতের আয় ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের আয় থেকে বাদ দিয়ে কর গণনা করা হতো।