রোববার, ০১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
শুল্ক কাঠামোয় বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত

বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে চায় সরকার

অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
  ৩০ মে ২০২৫, ১৮:১৩
বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে চায় সরকার
ছবি: সংগৃহীত

২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ সরকার আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে। এই সংস্কারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আরোপিত সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) প্রায় ৫০০ ধরনের পণ্যে কমানো বা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় মাছ, প্রাণীজ আইটেমসহ অপ্রচলিত পন্য এবং কিছু মধ্যবর্তী কাঁচামালের মতো তুলনামূলক কম আমদানিকৃত পণ্যও রয়েছে।

1

অন্যদিকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নীতিমালা প্রতিপালন করতে ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য তুলে দেয়া হচ্ছে প্রায় ৪০ ধরণের পণ্যে। ক্যান্সারসহ ৫৯ ধরণের ওষুধের কাঁচামালের আমদানি শুল্কও প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে সূত্রগুলো টিবিএসকে জানিয়েছে।

তবে স্টিলের কাঁচামালে বিদ্যমান কাস্টমস শুল্ক প্রত্যাহার করে, কৌশলে তার চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) মিলিয়ে বাড়ানো হচ্ছে, যার ফলে প্রকৃত কর বাড়বে ৪০ শতাংশের বেশি।

আবার স্থানীয় শিল্পকে দেওয়া প্রতিরক্ষণ সুবিধা তুলে নেওয়ার অংশ হিসেবে ১৪ ধরণের শিল্পের কাঁচামাল আমদানির শুল্ক বাড়তে পারে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ পর্যন্ত। কসমেটিক্স, ডোর লকসহ ২১ ধরণের পণ্যের ন্যূনতম মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ন্যূনতম মূল্য হলো, আমদানিকারক যে দামেই কোনো পণ্য আমদানি করুক – সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের নিচে ওই পণ্যের শুল্কায়ন হবে না। এতে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ কিছুটা কমে যায়।

অন্যদিকে বর্ত্মানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ধরণের পন্য আমদানি হয়, যা ট্যারিফ লাইন হিসেবে পরিচিত, হারমোনাইজড সিস্টেম বা এইচএস কোডের ভিত্তিতে – এসব পণ্যের বড় অংশের উপরই অতি উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক রয়েছে, আর শতাধিক পণ্য ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করা আছে, যা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের থেকে বিস্তর সমালোচনা আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলে এ ধরণের ট্যারিফ কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যা ডব্লিওটিও'র বিশ্ববাণিজ্যের মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্থানীয় শিল্পগুলোকে অনেক বেশি ট্যারিফ ওয়াল বা প্রতিরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হয়, যেটিকে 'ট্যারিফ ওয়াল' বা শুল্ক বাধা হিসেবেও প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। এটিও বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এনবিআর- এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের গড় আমদানি শুল্ক 28 শতাংশ, যেখানে এলডিসিগুলোর গড় এর অর্ধেকেরও কম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, "গত তিন বছরের মধ্যে এবারই ব্যাপকহারে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ট্যারিফ লাইনের সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ও নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) কমানোর প্রস্তাব আসতে পারে।" অবশ্য তিনি বলেন, যেহেতু এসব পণ্য আমদানি কম হয়, ফলে বড় অংকের রাজস্ব কমবে না। কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণ কমানো এবং কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক প্রতিরক্ষণের সুবিধার প্রস্তাব বাজেটে থাকবে বলেও জানান তিনি।

শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে যেসব পণ্যে

স্থানীয় ১৪টি উৎপাদনখাত—যেমন বেভারেজ বা পানীয়, এলইডি বাল্ব, ওয়াটার পিউরিফায়ার, ফ্যান, সিগারেট কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ—এর কাঁচামালে শুল্ক তিনগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। প্রভাবিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে শিশুদের জন্য ব্যবহৃত মল্ট এক্সট্র্যাক্ট ও আটা-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের পুষ্টি উপাদান বা সাপ্লিমেন্ট।

বেভারেজ কনসেন্ট্রেট আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। সয়া প্রোটিন-ভিত্তিক খাবার ও তামাক শিল্পে ব্যবহৃত সিগারেট পেপারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হতে পারে। স্যাটিন ফিতা তৈরিতে ব্যবহৃত ওভেন কাপড়ের ওপরও একই ধরনের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। তাছাড়া, ফ্যান উৎপাদনে ব্যবহৃত নন-অ্যালয়ড অ্যালুমিনিয়াম শিট, ওয়াটার পিউরিফায়ারের যন্ত্রাংশ, এবং টেলিভিশন তৈরির জন্য ব্যবহৃত এলইডি বাল্ব ও ওপেন-সেল প্যানেলের ওপরও শুল্ক বাড়তে পারে। এলইডি ল্যাম্পের ওপর শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত সিগারেট পেপারের ওপর শুল্ক হতে পারে ৩৫০ শতাংশ পর্যন্ত।

সরকার লিপস্টিক, আই মেকআপ, ম্যানিকিউর পণ্য, ফেস পাউডার, কসমেটিকস, ফেসওয়াশ, খেলনা এবং বিভিন্ন ধরনের তালা– এসব পণ্যের ন্যূনতম কাস্টমস মূল্যও বাড়াতে পারে, যার ফলে ঘোষিত মূল্যের ওপর ভিত্তি না করে নির্ধারিত মূল্যের ওপর কর পরিশোধ করতে হবে আমদানিকারকদের।

আরও যেসব পণ্যের ওপর নতুন বা বাড়তি শুল্ক আসতে পারে—তার মধ্যে রয়েছে তামাক বীজ (২৫ শতাংশ), সয়াবিন মিল (৫ শতাংশ) এবং কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাওলিন ক্লে। গ্রানাইট ও মার্বেলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হতে পারে। সিমেন্ট শিল্পে ক্লিংকার আমদানির ওপর নির্ধারিত শুল্ক বাতিল করে ২৫ শতাংশ অ্যাড ভ্যালোরেম শুল্ক আরোপের প্রস্তাব রয়েছে, যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। রেফারেল হাসপাতালের জন্য আমদানিকৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। কম্পিউটার এক্সেসরিজ আমদানির ওপর চলমান কর রেয়াত বাতিলের পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে, যার ফলে প্রযুক্তিখাতে খরচ বাড়তে পারে। এসব পরিবর্তন মূলত বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণকে সামনে রেখে শুল্ক কাঠামোর যৌক্তিকীকরণের অংশ, যার লক্ষ্য স্থানীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করে বাণিজ্যে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন।

যেসব শুল্ক কমতে পারে

বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক প্রতি টন ৪,৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৪,০০০ টাকা করার প্রস্তাব থাকতে পারে। মাইক্রোবাস আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবও বিবেচনায় রয়েছে।

ক্রুড ফুয়েল অয়েল বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে, এবং অন্যান্য জ্বালানি আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ কমানো হতে পারে। তবে এবার থেকে জ্বালানির ওপর শুল্ক নির্ধারিত হবে ইনভয়েস মূল্যের ভিত্তিতে, ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে নয়। স্থানীয় শিল্প যেমন টায়ার, টিউব, ব্রেক সু, ব্রেক প্যাড, মার্বেল ও গ্রানাইট উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর প্রস্তাব থাকতে পারে। ক্রিকেট ব্যাট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইংলিশ, কাশ্মীরি ও কোকোনাট উইলো কাঠ আমদানির কর ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হতে পারে।

স্থানীয় শিল্প বিকাশে সহায়ক হিসেবে, সয়াবিন মিল, কাগজশিল্পের জন্য কাঁচামালের ওপর শুল্ক হ্রাস এবং চামড়া শিল্পের জন্য কিছু রাসায়নিক উপাদানে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া বাটার বা মাখন আমদানিতে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক (আরডি) প্রত্যাহার এবং নিউট্রালাইজড সয়াবিন তেল- এর শুল্ক রেয়াতের প্রস্তাব থাকতে পারে। জাপানিজ সি ফুড স্ক্যালোপ আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ হতে পারে। পরিবেশবান্ধব পণ্যের কাঁচামাল যেমন সুপারি পাতার ওপর শুল্ক ৫ শতাংশ করা হতে পারে। নন-অ্যালকোহলিক জুস আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০০ শতাংশ করার প্রস্তাবও থাকতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় শিরিষ কাগজ শিল্পের প্রয়োজনীয় ফেনোলিক রেজিন ও স্যান্ডপেপার জাতীয় কাঁচামালের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে