সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অণুজীবময় বিশ্ব

মোঃ ইকরামুল করিম
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:৫৮

অণুজীব (Microorganism) কে বলা যেতে পারে পৃথিবীর সকল জীবনের ভিত্তি। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নেই, যে মাটির উপর নির্ভর করি কৃষি কাজের জন্য, যে পানীয় পান করি, যে প্রক্রিয়ায় খাদ্য পরিপাক করি- মোট কথা, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই অণুজীবের কার্যকলাপের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পৃথিবীর সর্বত্রই অণুজীব বিদ্যমান। এই অণুজীবরা মানুষের ত্বকের পৃষ্ঠ থেকে শুরু করে বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার এবং গভীর সমুদ্র পৃষ্ঠের হাইড্রোথার্মাল ভেন্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এ থেকেই অনুমান করা যায় অণুজীবরা মানবজাতির বহু আগে থেকেই এই পৃথিবীতে বিরাজমান। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ জেনে বা না জেনে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব থেকে অনেক রকমের উপকার পেয়ে আসছে। অতীতের সাধারণ মানুষজন সবসময় এই উপকারগুলোকে জাদু বা ঈশ্বরের উপহার বলে মেনে নিয়েছিল। আঙ্গুর থেকে কিভাবে মদ হয়, গম থেকে কিভাবে বিয়ার হয়, কিংবা দুধ থেকে কিভাবে পনির হয় এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অণুজীব ঘঠিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে আঠারো শতকের সেই সকল লোকজন অজ্ঞাত ছিল বা কোনরুপ জিজ্ঞাসা ছিল না ৷ ১৬৬৫ সালে জিরোলামো ফ্রাকাস্টোর (Girolamo Fracastoro) কতৃর্ক প্রস্তাবিত "Theory of contagious disease" তত্ত্ব এই অণুজীব গঠিত প্রক্রিয়া সমূহ বুঝতে সহায়তা করে ৷ আর তারই ধারাবাহিকতায় এন্টনি ভ্যান লিউয়েনহুক (Antonie Van Leeuwenhoek ) এবং রবার্ট হুক (Robert Hooke) কে তাদের অসাধারণ যুগান্তকারী কাজের জন্য অণুজীববিজ্ঞান (Microbiology) এর স্থপতি বলা যেতে পারে ৷ ১৬৬৫ থেকে ১৬৭৮ সালের মধ্যে রবার্ট হুক’ই সর্বপ্রথম অণুজীবের একটি চিত্রণ উপস্থাপন করেন যা লিউয়েনহুক’কে অনুপ্রানিত করে সর্বপ্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে জীবন্ত অণুজীব পর্যবেক্ষণ করতে । যদিও বা তাদের এই আশ্চর্যজনক সাফল্য তাৎক্ষণিক সমসাময়িক মানুষজন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, যেহেতু সেসময়ে অনেকেই "Spontaneous Generation" তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে সত্যিকার অর্থে অণুজীববিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হতে প্রায় ১৫০ বছর লেগেছে। আর অণুজীববিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার জন্য লুইস পাস্তুর, এডওয়ার্ড জেনার, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং সহ অনান্যদের আন্তরিক সাধুবাদ জানাই যারা অণুজীবকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

গত ১০০ বছরে অণুজীব বিজ্ঞানের অভাবণীয় অগ্রগতি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন জেনে গেছে CRISPR-Cas 9 এর মত পদ্ধতি দিয়ে নিপূনভাবে অণুজীবকে পরিবর্তন করে দুরারোগ্য রোগব্যাধী যেমন – ক্যান্সার নিরাময়ে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে স্বল্প সময়ে অত্যাধিক পরিমানে আমাদের নিত্য ব্যবহার্য শিল্পসামগ্রী উৎপাদন করতে হয় এবং কিভাবে শিল্পবর্জ্য দূষণ নিরাময় করতে হয়। মানব ইতিহাসের অন্যতম একটি মাইলফলক হলো ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH) কর্তৃক “The Human Microbiome Project” এর যাত্রা শুরু করা। মানব শরীরে ভেতরে ও বাহিরে বিভিন্ন অণুজীব সম্পর্কে জানা এবং সে সকল অণুজীবের মানব সাস্থ্য ও রোগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা অবলোকন করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এটি একটি অবাক হওয়ার মত বিষয় যে মানবশরীরের নিজস্ব কোষের তুলনায় অণুজীবের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তার অণুপাত হচ্ছে ১০:১। আরও অবাক করার বিষয় হচ্ছে এই অণুজীবের ৯৫% এরই আবাস্থল মানুষের অন্ত্র। এ থেকেই অনুমেয় মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগে অণুজীবের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ৯০% রোগব্যাধী কোন না কোনভাবে অন্ত্রস্থ অণুজীবের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমস কলামিস্ট ও লেখক কার্ল জ্যিমার (Carl Zimmer) এর “A Planet of viruses” পড়লে আমরা অনুধাবন করতে পারি HIV, MERS, Ebola এর মত আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের রয়েছে পৃ্থিবী পাল্টে দেওয়ার মত ক্ষমতা। চলমান COVID-19 মহামারী তারই একটি জলন্ত প্রমাণ। যদিওবা অণুজীব মানেই ‘জীবাণু’ যা রোগব্যাধী সৃষ্টি করে সবসময় এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। ঊনিশ শতকে গুটিবসন্তের টীকা আবিষ্কার এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে পেনিসিলিন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার ওষুধ শিল্প অণুজীব ব্যবহারের প্রাথমিক অগ্রগতি বলা যেতে পারে। বর্তমানে সহস্র অণুজীবঘঠিত যৌগ আবিষ্কৃত হয়েছে যা বহুলভাবে এন্টিভাইরাল, এন্টিবায়োটিক এবং এন্টিফাংগাল ড্রাগ হিসেবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও অণুজীব-ভিত্তিক সাপ্লিমেন্ট এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে সৃষ্ট ডায়রিয়া বা রোগ নিরাময়ে একটি নতুন দিগন্ত হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (FDA) সর্বপ্রথম ২০২৩ সালে মুখে সেবনযোগ্য অণুজীব ভিত্তিক সাপ্লিমেন্ট “SER-19” (বাণিজ্যিক নাম Vowst) এর অনুমোদন দিয়েছে Clostridiodes diffcile নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট ডায়রিয়া নিরাময়ে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও প্রকৃতিতে অণুজীবের অস্তিত্ব ও ভূমিকা অতুলনীয়। অণুজীবরা প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও জীব-ভূ-রাসায়নিক (Biogeochemical) চক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ত্যাগ করে ও ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস শোষণ করে, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বর্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান নাইট্রোজেন সরবরাহ করে এবং মৃত জৈব-সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত করে নতুন জীবন সৃষ্টিতে পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাছাড়াও, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় টেকসই পরবর্তী প্রজন্মের জীব-জ্বালানী (Biofuel) উৎপাদনে সালোকসংশ্লেষী অণুজীব যেমন – ক্ষুদ্র শৈবাল ও সায়ানোব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। শিল্পক্ষেত্রে অণুজীবের ব্যবহার উল্লেখ করার মতন। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন – পাউরুটি, দই, পনির, প্রক্রিয়াজাত মাংস, এনজাইম ও পানীয় ইত্যাদি উৎপাদনে অণুজীব ও তাদের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরণের অতি-সহনশীল (Extremophilic) অণুজীব ব্যবহার করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্প-জীব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলেছেন। আর অতি-সহনশীল অণুজীবের একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে আকরিক হতে বিভিন্ন অণুজীবঘঠিত জীব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মূল্যবান ধাতু, যেমন -কপার, সোনা ও ইউরেনিয়াম আহরন করা যা বায়োমাইনিং (Biomining) নামে পরিচিত। বিশ্বের সর্ববৃহৎ কপার বায়োমাইনিং কোম্পানি হচ্ছে “Biosigma” যেখানে চিলি’র আতাকামা মরুভূমি (Atacama Desert) হতে প্রাপ্ত আকরিক থেকে অতি-সহনশীল অণুজীব Acidothiobacillus ferrooxidans এবং Thiobacillus ferroxidans ব্যবহারের মাধ্যমে কপার উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে, বিশ্বের ২০% কপার উৎপাদন করা হয় বায়োমাইনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শুধু তাই নই, শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই বায়োমাইনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাশূন্যে গ্রহাণুপুঞ্জ বা ভিন গ্রহ থেকে বিরল ভূ-উপাদান (Rare Earth Elements) আহরণ করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। অতি সম্প্রতি, ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এ ‘BioRock’ নামক একটি পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে Sphingomonas desiccabilis নামক ব্যাকটেরিয়, চন্দ্র ও মঙ্গল গ্রহে বিদ্যমান অনুরূপ যৌগ, ব্যাসাল্ট (Basalt) থেকে বিরল-ভূ উপাদান আহরণ করতে পারে।

পরিশেষে, একুশ শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক উদ্যোগগুলোর একটি হলো বহির্জাগতিক প্রাণের (Extraterrestrial life) অস্তিত্বের অনুসন্ধান করা। এলিয়েন সভ্যতার সূত্র খোঁজার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রাতের আকাশে রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু অণুজীববিজ্ঞান কি অন্যান্য গ্রহে বা এমনকি গ্রহাণু এবং গভীর মহাকাশে জীবন বা প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলতে বা ধারণা দিতে পারে? বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন অতি-সহনশীল বা এক্সট্রিমোফিলিক অণুজীবরা পৃথিবীতে বিদ্যমান বিভিন্ন চরমভাবাপন্ন পরিবেশে যেভাবে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে বেঁচে থাকে, তা অনেকটা ভিনগ্রহে বিদ্যমান চরমভাবাপন্ন পরিবেশের ন্যায় যেটা কিনা অদূর ভবিষ্যতে বহির্জাগতিক প্রাণের অনুসন্ধানের খোরাক হতে পারে কিংবা এমন কোন বহির্বিশ্বের সন্ধান দিতে পারে যেখানে পূর্বে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল যার ধ্বংসাবশেষ (Fossil) বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ- এন্টার্কটিকা মহাদেশের লেক ভস্টক (Lake Vostok) এ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অণুজীবের ক্রিয়া-কলাপ আবিষ্কার করেছেন, যেটা অনেকটা জুবিয়ান চাঁদ ইউরোপা’র (Europa) মত হিমশীতল ও অলিগোট্রপিক (oligotrophic) পরিবেশের সমতুল্য। অন্যদিকে, আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত উষ্ণ প্রসবণ (Hot springs) এ হাইপারথার্মোফিলিক এর মত এক্সট্রিমোফিলিক অণুজীবের অবিষ্কার আমাদের প্রতিবেশী মঙ্গলগ্রহের অনুরূপ পরিবেশের সাথে সাদৃশ্য বহন করে। আমাদের সৌরজগতের একমাত্র চাঁদ টাইটান এর অ্যামোনিয়া ও মিথেন সমৃদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য বায়ুমন্ডল রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে, বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত পরিবেশের অ্যামোনিয়াম ও মিথেন একত্রিত হয়ে জৈব যৌগ গঠন করতে পারে এবং গভীর সাগরের তলদেশের উষ্ণ প্রসবনে বিদ্যমান অনুরূপ এক্সট্রিমোফিলিক অণুজীব এই মিথেন-সমৃদ্ধ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মঙ্গলের মাটির অনুরূপ উপাদান দিয়ে তৈরিকৃত মাধ্যম (Medium – গবেষণাগারে অণুজীব চাষ করার জন্য তৈরি বিশেষ বৃদ্ধিবর্ধক খাবার) এ মিথানোজেনস (Methanogens) চাষ (culture) করার মাধ্যমে মঙ্গলের মাটিতে যে প্রাণ বা জীবনের অস্তিত্ব সমর্থন করতে পারে তা প্রাথমিকভাবে প্রতিপাদন করেছেন যুক্তরাস্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ আরকানসাস এর একদল বিজ্ঞানী।

সর্বোপরি, প্রাণ বা জীবনের সাথে কোন অণুজীবের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য । সমগ্র জীবকুলের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ অণুজীব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, অণুজীবের মাধ্যমে জীবনের উৎপত্তি, বিকাশ এবং অণুজীবের মাধ্যমেই জীবনের বিনাশ ।

মোঃ ইকরামুল করিম

পিইএচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ

সহকারী অধ্যাপক, অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

যাযাদি/এসএস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে