সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক

সাজু আহমেদ
  ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২১

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ এখন দেশের প্রায় প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত এই বায়োপিকটি মুক্তির পর থেকেই দর্শক, শিল্পী ও কলাকুশলী সব শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সিনেমা হলের চিত্র দেখে এবং দর্শক, হল মালিক, চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও সুধীজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নানান তথ্য। সবাই যেন একবাক্যে পুরো ছবিটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অনেকের ধারণা ছিল এটি হয়ত কোনো প্রামাণ্যচিত্র ঘরানার কিছু হবে। কিন্তু সিনেমা হলে সেই ধারণা পাল্টে যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমারই স্বাদ ছিল গোটা বায়োপিকে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে দর্শক ও চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে।

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া...

মুক্তির শুরু থেকেই সিনেমাটি দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলেন প্রায় সব বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা। সাধারণ মানুষও পরিবারসহ চলচ্চিত্রটি দেখতে যাচ্ছেন আশপাশের প্রেক্ষাগৃহে। পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরাও সিনেমাটি আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। কেউ কেউ একবার নয়, বারবার দেখছেন। ইতিবাচক দিককে একপাশে সরিয়ে রেখে কিছু বিজ্ঞ দর্শক ও সমালোচক সিনেমায় কিছু অসঙ্গতির কথা জানিয়েছেন। তারা যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ ব্যাপ্তির দিক থেকে এটি পরিপূর্ণ সিনেমা, তবে বায়োপিক হিসেবে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে চিত্রনাট্য এবং পার্শ্ব চরিত্র চিত্রায়নে আরও সতর্ক হওয়ার সুযোগ ছিল। কতিপয় অসঙ্গতিকে এড়িয়ে এটাকে আরও ইতিহাসসমৃদ্ধ বা ইতিহাসের আরো কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যেত। সেই প্রচেষ্টায় কিছুটা ঘাটতি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মতো একটি চরিত্র বা বিশেষ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এত বড় আয়োজনে কাজ হয়েছে সেটাই অনেক বড় বিষয়। বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমী তো বটেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় বিশ্বাসী তথা সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই বায়োপিকটি অন্যরকম এক বড় পাওয়া। বাংলাদেশের সংস্কৃতির জন্য একটি বৃহত্তর এবং প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে এই সিনেমাটি এমনটাই মনে করছেন সিনে বিশ্লেষকরা। অভিনেতা হিসেবে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন আরেফিন শুভ এবং নুসরাত ইমরোজ তিশাসহ আরও অনেকে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রাভিনেতারও যে যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন ভালো করার।

প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের বক্তব্য...

রাজধানীর মধুমিতা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, সিনেমাটি আমার এখানে ভালোই যাচ্ছে। সিনেমাটি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, সাধারণ অন্য সিনেমা যেমন যায় তার থেকে ভালো যাচ্ছে। সিনেমা সবার মধ্যেই এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করছে। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে শুরু থেকেই প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের আগ্রহ অনেক বেশি লক্ষণীয়। সব মিলিয়ে খুবই ভালো যাচ্ছে। তবে লায়ন সিনেমা হলের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক জানালেন একটু ভিন্ন কথা। তিনি বললেন, আমার এখানে খুব ভালো যাচ্ছে না। যে পরিমাণ দর্শক হওয়ার কথা, আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল সেটা পূরণ হচ্ছে না। মির্জা খালেকের মতো ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি সিনেমা হল মালিকরাও জানান প্রায় একই কথা। বিশেষ করে সিঙ্গেল স্ক্রিনে ছবিটি হাউসফুল না গেলেও সন্তোষজনক দর্শক পাচ্ছেন তারা।

কী বলছেন সাধারণ দর্শক...

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকটি দেখার জন্য মরিয়া ছিলেন রাজধানীর বনশ্রীর রাজু আহমেদ নামের এক চাররিজীবী। ছুটির দিন ছিল তার জন্য মোক্ষম সময়। এ কারণে শুক্রবার ইভিনিং শো দেখতে ঢুকে পড়েন মধুমিতা সিনেমা হলে। সিনেমা শেষে তাকে প্রশ্ন করা হলো সিনেমাটি কেমন লাগলো? জবাবে রাজু জানান, সত্যি কথা হচ্ছে, আমার কাছে অসম্ভব ভালো লেগেছে। সিনেমাটি দেখে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে অনেক তথ্যই জানা হলো; যেগুলো আমার ধারণাতেই ছিল না। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল লাইফে তার স্ত্রীর যে ইনভলবমেন্ট ছিল এটা আমার জানা ছিল না। তৌহিদ নামে আরেক দর্শক বলেন, হোসেন শহীদের কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর গড়ে ওঠার যে ব্যাপারটি ছিল সেটাসহ আরও অনেক কিছু জানা হলো। আমরা আরও মোর ডিপলি এনকাউন্টার করেছি। এক্সপেরিয়েন্সটা বুঝতে পেরেছি কীভাবে শেখ মুজিব তৈরি হলেন। তানিয়া ফেরদৌস নামে এক দর্শক বলেন, মুভিতে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন সেটা অনেক সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে আসা দর্শক সিহাব শাহরিয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনটাকে আরও ভালোভাবে দেখার জন্য সিনেমাটি দেখে আমি তৃপ্ত। শাহিন হোসেন নামে এক দর্শক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস যতটা বইতে পড়েছি, পর্দায় জীবন্ত বঙ্গবন্ধুকে কেমন লাগে সেটা দেখতে এসেছি। কিছু ছোট ছোট জিনিস বাদ দিয়ে দারুণ একটি ইতিহাস তৈরি হয়েছে। শারমিন সুলতানা নামে এক দর্শক বলেন, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ এক সূত্রে গাঁথা। তার জীবনী পর্দায় দেখলাম। দারুণ লেগেছে। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাতে দেখতে আসা দর্শক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘ইটস অ্যামেইজিং। বঙ্গবন্ধুকে যেন জীবন্ত দেখলাম।

অভিনয় শিল্পীদের ভাষ্য...

‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা আরিফিন শুভ বলেন, বায়োপিকে এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছি, যে চরিত্রটা বাঙালির কাছে ভীষণ আবেগের। সিনেমাটির দর্শক সাড়া পাওয়ায় আমি অভিভূত। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান চরিত্রে অভিনয় করা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই প্রথম এত বড় আকারে একটি কাজ। একজন মানুষ একটা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, সিনেমাটিতে সেই সত্যি ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দর্শকরা উপভোগ করছেন জেনে ভালো লাগছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ চরিত্রের অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু বলেন, বায়োপিকে অভিনয় করা আসলেই ভীষণ কঠিন কাজ। মুক্তির পর সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের যে আবেগ তৈরি হয়েছে তাতে আমি আপ্লুত। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রেণু চরিত্রের অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা বলেন সিনেমাটি দর্শকদের এত এত রেসপন্স দেখে আমি হতবাগ আবেগাপ্লুত। অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদীন দীঘি বলেন, ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমা দেখে দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া আমার অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।

কতিপয় অসঙ্গতি... চলচ্চিত্রে যুবক মুজিব ও কিশোরী রেণুর বিয়ের আয়োজন দেখানো হয়েছে। কিন্তু মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, যখন তার বিয়ে হয় তখন বয়স বার/তের হতে পারে। রেণুর বয়স তখন তিন বছর হবে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে ‘মুজিব’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম রিকশায় আসেন এবং নামেন বর্তমান কলাভবনে। অথচ ১৯৪৭ সালে কলাভবন ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের ভেতরে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসেন। ঢাকা এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় থাকা লাখো জনতার মধ্যে স্বাধীন দেশে পা ফেলেন তিনি। বিমানের সিঁড়িতেই বহু মানুষ তার গলায় মালা পরান। তখন সিঁড়ির কাছেই হাজারো মানুষ ভিড় করে, সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চায় এবং জাতির পিতাকে স্পর্শ করতে চায়। অথচ সিনেমায় দেখানো হয়েছে তিনি ধীরে ধীরে নামছেন, সঙ্গে মাত্র তিনজন লোক। নেমে মাটিতে সেজদা বা চুমু দিলেন, পাশে লাল কার্পেট বিছানো, সুশৃঙ্খল ব্যান্ড পার্টি, পাশে দাঁড়িয়ে মালা হাতে নেতারা। একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, ৩২ নম্বরের দোতলা বাড়িতে প্রবেশ করছে বালক শেখ কামাল, জামাল ও কিশোরী শেখ হাসিনা। অথচ ইতিহাস বলে ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার প্লটের বাড়িতে শেখ পরিবার যখন প্রবেশ করেন তখন এটি দুই কামরার একতলা বাড়ি ছিল। এরপর বেগম মুজিবের তৎপরতায় তিল তিল করে ধীরে ধীরে বাড়িটি দোতালায় পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলাভবন গেট দিয়ে ছাত্রদের যে মিছিল বের হয় সেই মিছিলে গুলি হয়নি, সেই মিছিলের কেউই মারা যাননি। তবে সমালোচনার ভিড়ে ভালো লাগার অসংখ্য দৃশ্য রয়েছে সিনেমায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মুজিব এবং রেণুর বিয়ের গান ‘কি কি জিনিস এনেছো দুলাল বিবি সখিনার লাইগা’ গানটির চিত্রায়ন আলাদা ভালোলাগার বিষয় ছিল। নানা কারণে সিনেমাটি বাংলাদেশি মানুষের কাছে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে