রোববার, ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

ইকোবাজার: প্লাস্টিক-মুক্ত মেলা উদ্বোধন

যাযাদি ডেস্ক
  ২৯ জুন ২০২৫, ১৯:০২
ইকোবাজার: প্লাস্টিক-মুক্ত মেলা উদ্বোধন
ছবি : যায়যায়দিন

প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা মোকাবিলা এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে আজ রাজধানীতে আয়োজিত হলো 'প্লাস্টিক থেকে মুক্ত হন - প্লাস্টিকের বিকল্প বিষয়ক আলোচনা ও ইকোবাজার'। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক নির্ভরতা কমানো ও টেকসই বিকল্প উপকরণ প্রদর্শর্নীর মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে একজোট হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৫ উপলক্ষ্যে রোববার (২৯ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিবেশ অধিদপ্তরের মিলনায়তনে একশনএইড বাংলাদেশ, নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম), সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাস্টিস বাংলাদেশ (সিসিজে-বি) এবং পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম 'ইকোবাজার: প্লাস্টিক-মুক্ত মেলা' উদ্বোধন করেন। এই মেলায় কমিউনিটি-ভিত্তিক ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্লাস্টিকের সৃজনশীল বিকল্প পণ্য, যেমন পাটজাত পণ্য, বাঁশের আসবাব এবং বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণ প্রদর্শন ও বিক্রি করে। আমন্ত্রিত অতিথিসহ সাধারণ দর্শনার্থীরা এই মেলায় স্টলগুলো ঘুরে দেখেন এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য সম্পর্কে জানেন।

এরপর পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মু. সোহরাব আলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্য দেন নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) নির্বাহী পরিচালক এস.এম. মুঞ্জুরুল হান্নান খান। পরে অনুষ্ঠানে ‘নিষেধাজ্ঞা থেকে অতিক্রম: নীতি, উদ্ভাবন, এবং অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নেকম-এর গবেষণা সহযোগী আজকা তৌহিদা ডাইবি, একশনএইড বাংলাদেশ-এর ডেপুটি ম্যানেজার তানজিয়া আন্জুম এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাসটিস বাংলাদেশের পরিচালক এম. হাফিজুল ইসলাম খান। একশনএইড বাংলাদেশ-এর হেড অফ প্রোগ্রাম ও এনগেজমেন্ট কাজী মোরশেদ আলম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

এসময় পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক শামিমা আক্তার, রেডঅরেঞ্জ কমিউনিকেশনসের ডিরেক্টর স্ট্যাটেজি জান্নাতুল মুনিয়া এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. নিয়াজ আল হাসান অংশ নেন। এরপর একটি উন্মুক্ত আলোচনা পর্বও অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সকলের অংশগ্রহণে প্লাস্টিক দূষণ এবং এর সমাধানের বিভিন্ন দিক উঠে আসে।

পুরো আয়োজনে মূলত বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের চ্যালেঞ্জ, এর ক্ষতিকারক প্রভাব এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় উদ্ভাবনী ও টেকসই সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বিকল্প উপকরণগুলোর প্রদর্শনী ও এর ব্যবহার বৃদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বক্তারা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, তরুণনেতা এবং কমিউনিটির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

আলোচনায় সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-চিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩–২০২৫ সময়কালে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে প্রায় ৯৬% প্লাস্টিকই সরাসরি বর্জ্যে পরিণত হয়। শহুরে এলাকায় প্রতি ব্যক্তির প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ৩ কেজি থেকে ২০২০ সালে ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। ঢাকায় এই পরিমাণ ২০২০ সালে ২২.২৫ কেজি ছিল। যা ২০০৫ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। দেশে প্রতিদিন ৬৪৬ টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার অর্ধেকের বেশি নদী-নালা ও ল্যান্ডফিলে গিয়ে পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় ঢাকার নদ-নালা ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপজ্জনক মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি ধরা পড়েছে। প্রতি লিটার পানিতে গড়ে ৩০টিরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা সরাসরি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় প্রতি বর্গমাইলে ৪৬,০০০ টুকরো প্লাস্টিক কণা জমা হয়েছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

এই প্রেক্ষাপটে বক্তারা জোর দেন টেকসই বিকল্প ব্যবহারে এবং পাট, বেত, পচনশীল উপাদানের ওপর। তারা বলেন, প্লাস্টিকের বিকল্প উদ্ভাবন ও উদ্যোগগুলোকে সরকার ও কর্পোরেট খাত পক্ষ থেকে আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া দরকার।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম প্লাস্টিক দূষণ রোধে সরকারি নীতি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, “প্লাস্টিক দূষণ বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সংকট। এটি মোকাবিলায় সরকার বহুমুখী নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরা প্লাস্টিক পণ্য আমদানি বন্ধ করে বরং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য রপ্তানির ওপর জোর দিচ্ছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়াতে আমরা পরিবেশগত নীতি (ইপিআর) সংশোধনের মাধ্যমে আরও জোরদার করেছি। আমাদের প্রচুর নিজস্ব প্লাস্টিক বর্জ্য আছে যা পুনর্ব্যবহার করে রপ্তানি করা যেতে পারে।”

প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোয় আইনের সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি উল্লেখ করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) নির্বাহী পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, “আমরা বছরে ১৭-২০ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন করি, যা প্লাস্টিকের একটি টেকসই বিকল্প হতে পারে। বুড়িগঙ্গার মতো আমাদের নদ-নদীগুলো মানবসৃষ্ট বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা বিকল্প ভাবছি না। কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক বাস্তবায়ন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।” প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে নতুন উদ্ধাবনগুলোকে প্রনোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে

তিনি বলেন, “পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এই চর্চা শুরু করতে হবে। নতুন উদ্ভাবনে প্রণোদনা দিয়ে ছোট ছোট উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, কারণ প্রকৃতিকে রক্ষা করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

একশনএইড ইন্টারন্যাশনালের আইএইচএআরটি-এর গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স অ্যাডভাইজার তানজীর হোসেইনের সমাপনী বক্তব্যে বলেন, “প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় সহযোগিতা ও উদ্ভাবন জরুরি। যুবসমাজ ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে টেকসই সমাধান গড়ে তুলে পরিবেশ রক্ষা করি।”

অনুষ্ঠানে এসময় পরিবেশ নীতি নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ ও প্লাস্টিক সংক্রান্ত গবেষণায় নিয়োজিত শিক্ষাবিদ ও গবেষক, পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবনে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সুযোগ সন্ধানকারী বাণিজ্যিক অঙ্গন এবং টেকসই উন্নয়নে আগ্রহী উদ্যোক্তা ও যুবনেতারাসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে