শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্যময় দেশি ধানের জাত

শামীম আহমেদ
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে শৈশবে ভাতের পাতে নানারকম বৈচিত্র্য দেখেই বড় হয়েছি। যেমন ঘরে মাংস রান্না হলে- পর্বতজিরা চাল রান্না হতো কিংবা শুঁটকির ভর্তা রান্না হলে ইরি চাল, দুধ ও কলা দিয়ে খেতে চাইলে বিরুন চালের ভাত রান্না করা হতো, আবার পশুর আইল দিয়ে পিঠা তৈরি করা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। তার জায়গা দখল করছে হাইব্রিড ধান।

বিভিন্ন ধান গবেষণায় দেখা যায়, প্রাকৃতিক গুণাগুণকে পাশকাটিয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধ হাসিলের জন্য ধান 'পেন্টেন্ট' করা শুরু হয়। পেন্টেন্ট শব্দের আভিধানিক অর্থ সংরক্ষণ করা। বীজকে রাসায়নিকভাবে পরির্বতন করা, যাতে এক ফসল উৎপাদনের পর তার থেকে আরেক ফসল উৎপাদন করা না যায়। ফলে পরে বীজ কেনার জন্য উন্নয়নশীল দেশ উন্নত বিশ্বের বীজ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তান দেশি জাতের ধান গবেষণা ও সংরক্ষণে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে। দেশ দুইটিতে এখন স্স্নোগান উঠেছে 'চিকিৎসকে টাকা না দিয়ে কৃষকে দেন'। এ আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

জানা গেছে, সত্তর বছর আগে ড. হেক্টর নামে এক গবেষক ধান নিয়ে গবেষণা করেন; তার গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন মৌসুমভিত্তিক অন্তত ১৮,০০০ জাতের ধান আবাদ হতো। কালে কালে তার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। এ সব জাতের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে বৈচিত্র্যিক জাতের ধানকেন্দ্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। গত শতাব্দির আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সারাদেশে আবাদকৃত প্রায় ১২,৫০০ জাতের নাম সংগ্রহ করেছিল।

বিরুন চাল এটি অনেকটা স্টিকি রাইস (আটালো ভাত) এর মতো। ভাপে রান্না করা এ ভাত আকৃষ্ট করে রসনাবিলাসীদের। বোয়াল, ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির ভাজা মাছ দিয়ে বিরুন চালের গরম ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। আবার দুধ, গুড় ও নারকেল মিশিয়ে খেতেও পছন্দ করেন অনেকে। সকালে তেল বা ঘি, পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে বিরুন ভাত ভেজেও খান কেউ কেউ। সুস্বাদু পিঠা তৈরিতে বিরুন চালের জুরি নেই। বিভিন্ন উৎসব-পার্বন এলে গ্রামবাংলার কৃষানিরা বিরুন চাল দিয়ে তৈরি করেন নারকেলের পাটিসাপ্টা, পায়েশ, টুইপিঠা, বিরুনপুরি, চুঙ্গাপিঠাসহ নানা রকম খাবার। ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপিঠা সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব প্রিয়। ভেজা বিরুন চাল নরম করে নির্দিষ্ট জাতের বাঁশের চুঙ্গার মধ্যে ভরে খড়কুটো দিয়ে পুড়িয়ে এ পিঠা তৈরি করা হয়। যা দুধের মালাই, খেঁজুরের গুড় ও দুধের সর দিয়ে খেতে মজা।

বর্তমানে কৃষকরা জমিতে অন্যান্য ধানের পাশাপশি নিজেরা খাওয়ার জন্য স্বল্প পরিমাণে বিরুন ধান চাষ করেন। প্রতি বছরের বোরো ও আমন মৌসুমে বিরুন ধান চাষ করেন তারা। অন্যসব ধানের তুলনায় এ ধানের ভাত সুস্বাদু। সুগন্ধী এ ধান ঘরে উঠানোর পর কৃষানিরা ভাত ও বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরি করে নিজেরা তো খানই, সেই সঙ্গে আত্মীয়স্বজনকেও আপ্যায়ন করে থাকেন। বিশেষ করে জামাই এলে এ ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা চাই-ই চাই। তাই ঐতিহ্যবাহী আটালো এ ভাতকে জামাইভাতও বলেন কেউ কেউ। অনেকে বিরুন চাল শহরে ও প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজনকে পাঠাতেও ভোলেন না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে