শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

পলস্নীকবির ছেলেবেলা

সাধন সরকার
  ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
পলস্নীকবির ছেলেবেলা

আ বহমান গ্রাম-বাংলার হাসি-কান্না, প্রেম- ভালোবাসা যার লেখায় ওঠে এসেছে তিনি কবি জসীমউদ্‌দীন। পলস্নীজীবনের সুখ-যাতনার কথা তুলে ধরে তিনি আমাদের সবার প্রিয় কবি হয়ে আছেন। কবি জসীমউদ্‌দীনের জন্ম ফরিদপুর জেলায়। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি তিনি তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম মোহাম্মাদ জসীমউদ্‌দীন মোলস্না হলেও তিনি জসীমউদ্‌দীন নামেই পরিচিত। কবির পিতা আনসারউদ্দীন মোলস্না ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে ছিল কবির পৈতৃক নিবাস।

কবি জসীমউদ্‌দীনকে প্রথমে গ্রাম্য পাঠশালায় পাঠানো হয়। এরপর ফরিদপুর ওয়েলফেয়ার স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে কবির শিক্ষাজীবন শুরু হয়। অতঃপর কবি ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা স্কুলে। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯২১ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৪ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (১৯২৪) পাস করেন। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের কবিতা পড়তে পড়তে কবির মনে কবিতা লেখার আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি আনমনে কবিতা লিখতে শুরু করেন। জানা যায়, ফরিদপুর স্থানীয় স্কুলের নামকরা শিক্ষক ক্ষিরোদ বাবুও তখন কবিতা লিখতেন এবং কবিতার দারুণ ভক্ত ছিলেন। কোনো না কোনোভাবে শিক্ষক ক্ষিরোদ বাবুর সঙ্গে কিশোর জসীমউদ্‌দীনের দেখা হয়। একদিন তিনি কবি জসীমউদ্‌দীনের কবিতা শোনেন এবং প্রশংসা করেন। পাশাপাশি কবিকে কবিতার বই পড়ার পরামর্শ দেন। শোনা যায়, এই ক্ষিরোদ বাবুই কবিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। সেখান থেকে কবি কবিতা লেখার অনুশীলন করতে থাকেন। ছোটবেলায় কুমার নদের তীরেই কেটেছে কবির শৈশব। শৈশবে নদী-নালা, বন-পাখি দেখে কবির মন উদাস সুরে হারিয়ে যেত। কবির আত্মজীবনী 'জীবন কথা' থেকে জানা যায় ছোটবেলায় কবি জসীমউদ্‌দীনের নিজের একটি বাগান ছিল। সেই বাগানে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় গাছটি ছিল পাতাবাহার। ছোটবেলায় ঘরের কাজ ফেলে স্কুলে যাওয়ার কারণে কবিকে অনেক বকাঝকা শুনতে হতো।

জসীমউদ্‌দীন একদম অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই পলস্নীপ্রকৃতি ও পলস্নীজীবনের মাটি ও মানুষের প্রেমে পড়ে যান। ছাত্রজীবনেই তার কবিত্ব প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম্য-পরিবেশ-প্রকৃতির দারুণ ভক্ত ছিলেন কবি। তাই তো তার লেখায় ওঠে এসেছে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতির অপরূপ রূপের অসাধারণ বর্ণনা। গ্রাম্য জীবনকে কেন্দ্র করে টুকরো টুকরো গল্পগাথা তার লেখার মধ্য দিয়ে দারুণভাবে ফুটে ওঠেছে। ছোটকাল থেকেই গ্রাম-বাংলার লেখালেখির মাধ্যমে তিনি শহরের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুধু দেশে নয়, গ্রাম-প্রকৃতির বিষয়বস্তুকে ধারণ করে তিনি বিদেশেও সমানতালে পরিচিতি লাভ করেন। কলেজে থাকা অবস্থায় সহজ-সরল ভাষায় তিনি বিখ্যাত কবিতা 'কবর' রচনা করেন। এটি একটি আলোচিত হৃদয়বিদারক কবিতা। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। 'কবর' কবিতা লেখার জন্য তিনি সব মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে তখনকার জনপ্রিয় পত্রিকা কলেস্নাল-এ তৃতীয় সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। কবির 'কবর' কবিতা পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন মুগ্ধ হন এবং কবির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

শিশু-কিশোরদের জন্য কবি প্রচুর লিখেছেন। সহজ-সরল ভাষায় তিনি শিশুদের মনের খোরাক জুগিয়েছেন। কবির শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- শিশু-কিশোর বই- 'হাসু' (১৯৩৮), 'এক পয়সার বাঁশি' (১৯৫৬), 'ডালিম কুমার' ইত্যাদি। 'হাঁসু'র প্রতিটি ছড়া-কবিতায় শিশুদের আবেগ-অনুভূতি ফুটে ওঠেছে। কবি লিখেছেন- 'আমার বাড়ি যাইও ভোমর/বসতে দেব পিঁড়ে/জলপান যে করতে দেব/শালি ধানের চিড়ে।...।' কবির 'রাখাল ছেলে' কবিতাটি সবার কাছে পরিচিত। এ কবিতার প্রথম দুটি পঙ্‌ক্তি হলো- 'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,/বাঁকা গায়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?' কবি জসীমউদ্‌দীনের রয়েছে দুরন্তপনায় ভরা শৈশব আর কৈশোর। তিনি কিশোরকাল থেকেই মেধার ছাপ রেখেছেন। কবির ছাত্রাবস্থায়ই তার 'কবর' কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পর্যায়ে পাঠ্য হয়। আবহমান গ্রাম-বাংলায় ঘটে যাওয়া সমাজের নানান দিক তিনি তার কলমে তুলে এনেছেন। ১৯২৭ সালে বলতে গেলে খুব অল্প বয়সেই তার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাখালী' প্রকাশিত হয়। খুব অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনা গড়ে ওঠে। তিনি পলস্নীকবি বা গ্রাম বাংলার কবি হলেও মূলত তিনিই নগর জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্থ মানুষের কাছে গ্রাম বাংলার রূপ-রস গন্ধকে তার লেখার মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন। তার রচিত কাহিনিকাব্য 'নকশী কাঁথার মাঠ' (১৯২৯) এবং 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' (১৯৩৩) পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে