মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাত ও হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে মেরুকরণ তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধের সরাসরি ঘোষণা না এলেও উভয়পক্ষের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলা চলছেই।
এতে প্রশ্ন উঠেছে—এই সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কোন দেশ কার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে?
ইরানের পক্ষে যেসব দেশ বা গোষ্ঠী রয়েছে
রাশিয়া
চীন চীন প্রকাশ্যে ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ড সমর্থন না করলেও ইরানকে ঘিরে মার্কিন প্রভাব হ্রাস করতে কূটনৈতিকভাবে পাশে রয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও ইরান চীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
সিরিয়া
লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। যাদের মুখ্য টার্গেট ইসরায়েল। ইসরায়েল সীমান্তে তারা এখনো হামলা অব্যাহত রেখেছে বলে জানা যায়। এরমধ্যে আজ শুক্রবার আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে লেবাননে ইসায়েলের ড্রোন হামলার খবর প্রকাশিত হয়ে।
ইয়েমেনের হুতি ইরানের আরেক মিত্র ইয়েমেনের হুতিরা। ইরানের সঙ্গে হুতিরাও ইসরায়েলকে টার্গেট করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এরমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে বলে জানা যায়।
পাকিস্তান সরকারিভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহাসিক বিরোধিতার কারণে পাকিস্তানে ইরানপন্থি জনমত শক্তিশালী। তবু সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্বে পাকিস্তান মাঝেমধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল নেয়।
উত্তর কোরিয়া
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় উত্তর কোরিয়া বরাবরই ইরানকে সমর্থন করে আসছে। প্রযুক্তিগত ও অস্ত্র সহযোগিতারও সন্দেহ রয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
এর মধ্যে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলকে ‘শান্তির বিরুদ্ধে ক্যান্সারের মতো সত্তা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে দেশটি। এছাড়া কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানায়।
কিউবা এবং ভেনেজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশ হিসেবে কূটনৈতিকভাবে ইরানকে সমর্থন করে।
বাংলাদেশ: আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তবে ইরান সম্পর্কেও কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখে।
ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থানকারী দেশসমূহ:
জি-৭ (G7) এর দেশগুলো যেমন- যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ইরানের সঙ্গে চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
সম্প্রতি কানাডায় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে তারা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে ইরানকে দায়ী করেছে।
ভারত ভারত সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি, তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। অস্ত্র কেনা-বেচা ও কৌশলগত দিক থেকে ভারত কার্যত ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তেল নীতিতে ভারসাম্য রাখলেও সামরিক নীতিতে ইসরায়েলপন্থি তারা।
আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ
সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সৌদি আরব কার্যত ইসরায়েলের পক্ষে। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সরাসরি সমর্থন না দিলেও ইরানের বিরোধিতায় পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।
মিশর ও জর্ডান
দেশগুলোর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি রয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা সহযোগিতাও চলছে। তবে জনমতের কারণে সরকারগুলো ইসরায়েল সমর্থনে সতর্ক রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ: ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ইরানের সাম্প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে তারা।
তুরস্ক
নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করছে।
কাতার
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে।
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত শুরু হয় মূলত ফিলিস্তিনকে নিয়ে। তাই ফিলিস্তিনের পক্ষে যাদের সমর্থন রয়েছে তারা পরোক্ষভাবে ইরানের পক্ষে। অন্যদিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মাঝামাঝি অবস্থানে অথবা সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছে তারা পরোক্ষ-প্রত্যোক্ষভাবে ইসরায়েলের পক্ষে।
এর আগে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাবে সংস্থাটির সাধারণ পরিষদে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ভোটে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে পাশ হয়। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদের জন্য ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয় সাধারণ পরিষদ।
সাধারণ পরিষদের ভোটের ফলে দেখা গেছে, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশসহ ১৪৩ দেশ। আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ৯ দেশ। ভোটদানে বিরত ছিল ২৫ দেশ।
ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলো হলো: আর্জেন্টিনা, চেচনিয়া, হাঙ্গেরি, ইসরাইল, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পলাউ, পাপুয়া নিউগিনি এবং যুক্তরাষ্ট্র। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যদি বাড়তে থাকে তাহলে এই দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর বেশিরভাগই ইউরোপের। এর মধ্যে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ফিজি, ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, রোমানিয়া এবং ইউক্রেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভোটদানে বিরত ছিল উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডাও। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে এই দেশগুলোর মধ্যেও প্রায়ই পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া-চীনের গোপন টানাপোড়েন, উপসাগরীয় মেরুকরণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিগুলোর কৌশলগত অবস্থান।—সবকিছু মিলিয়ে এটি বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারে।