বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

লন্ডনের পর এবার নিউইয়র্কও পেতে যাচ্ছে মুসলিম মেয়র!

যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ জুন ২০২৫, ২২:৫৭
লন্ডনের পর এবার নিউইয়র্কও পেতে যাচ্ছে মুসলিম মেয়র!
নিউইয়র্কের সম্ভাব্য ভবিষ্যত মেয়র জোহরান মামদানি। ছবি: এএফপি

কল্পনা করুন, ইহুদি-অধ্যুষিত নিউইয়র্কের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ কষ্ট ও সব ধরনের সমস্যার সমাধানের দায়ভার এক মুসলিমের হাতে। শুনতে রূপকথার মতো মনে হলেও আগামী কয়েক মাসেই তা সত্যে পরিণত হতে পারে।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আইনপ্রণেতা, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানি (৩৩) নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। আগামী নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি।

ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে এগিয়ে মামদানি অনানুষ্ঠানিক ফলাফলে দলটির মেয়র নির্বাচনের প্রাইমারিতে জিতেছেন তিনি। অপ্রত্যাশিতভাবে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে হার মেনে নিয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো।

চার বছর আগে যৌন হয়রানির অভিযোগে পদত্যাগের পর ৬৭ বছর বয়সী কুমো এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে চেয়েছিলেন।

জোহরানের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন বলে ভক্তদের জানান কুমো।

আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র হবেন জোহরান।

যুক্তরাষ্ট্রের রীতি অনুসারে, দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রাইমারি নির্বাচন বা এ ধরনের প্রক্রিয়া মেনে নিজেদের প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়। তবে প্রাইমারি বাদেও সর্বসম্মতিক্রমে একজন প্রার্থীও মনোনয়ন পেতে পারেন।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারিতে 'নিবন্ধনকৃত ডেমোক্র্যাট'রা ভোট দিয়েছেন। প্রাইমারির ২৫-৩০ দিন আগে ডেমোক্র্যাট ভোটার হিসেবে ওই শহরের যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক নিবন্ধন করতে পারেন।

এখন পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ ভোট গণনায় জোহরানের পক্ষে রায় দিয়েছেন সাড়ে ৪৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কুমো পেয়েছেন ৩৬ দশমিক চার শতাংশ ভোট।

আগামী সপ্তাহের আগে এই ফল চূড়ান্ত না হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, কুমো বা অন্য প্রার্থীর পক্ষে জোহরাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তৃতীয় অবস্থানে থাকা নগরের হিসাব নিরীক্ষক ব্যাড ল্যান্ডর ইতোমধ্যে তার সমর্থকদের 'দ্বিতীয় পছন্দ' হিসেবে জোহরানের নাম উল্লেখ করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

জাতীয় নির্বাচনেও সবচেয়ে জনপ্রিয় জোহরান ঐতিহাসিকভাবে নিউইয়র্কে জনপ্রিয় দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। দলের মনোনয়ন পেলে স্বভাবতই শক্ত অবস্থানে থাকবেন উগান্ডায় জন্ম নেওয়া জোহরান মামদানি।

বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস আবারও পুনর্নিবাচনের জন্য ভোটে দাঁড়াবেন। তবে ডেমোক্র্যাট নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি লড়বেন। ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও একাধিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে অনেকাংশেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন এরিক।

রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন কার্টিস স্লিওয়া। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুপরিচিত তিনি। ২০২১ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে এরিক অ্যাডামসের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন কার্টিস স্লিওয়া।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, ডেমোক্র্যাট ভোটাররা জোহরানের সম্ভাব্য বিজয়কে দলের জন্য 'নতুন যুগের সূচনা' হিসেবে দেখছেন।

এক ভোটার রয়টার্সকে বলেন, 'ভিন্ন চিন্তাধারার, ভিন্ন গোত্রের ও তরুণ কারও হাতে এই দায়িত্ব আসার সময় হয়েছে।'

জোহরানকে বেশি 'উদারপন্থি' হিসেবে উল্লেখ করে অপর এক ভোটার বলেন, তিনি কুমোকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি আরও বলেন, 'যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে, তাকে আমি কখনোই ভোট দেব না।'

জোহরানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জোহরানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বেশ উচ্চাভিলাষী।

এসবের মধ্যে আছে, নগরবাসীর জন্য বিনামূল্যে বাস সেবা, শিশুযত্ন নিশ্চিত করা, সরকারি ভর্তুকির বাসার ভাড়া না বাড়ানো ও নগর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মুদি দোকান চালানো।

এসবের অর্থ জোগান দিতে ধনীদের ওপর নতুন কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

জোহরান মামদানি বিবিসিকে বলেন, 'এই শহরে প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে। পাঁচ লাখ শিশু রাতে না খেয়ে ঘুমায়। এই শহরের বিশেষত্বটাই আজ হুমকির মুখে। সেটা রক্ষা করতে চাই।'

জোহরানের প্রচারে তাকে সমর্থন দিয়েছেন কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ ও সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। দুজনই ডেমোক্র্যাট সমাজতন্ত্রী হিসেবে সুপরিচিত।

'ফিলিস্তিনপন্থি' জোহরান জোহরানের পূর্বপুরুষ ভারত থেকে আসলেও তার জন্ম উগান্ডায়।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিক মাহমুদ মামদানি ও স্বনামধন্য ভারতীয়-মার্কিন চিত্রনির্মাতা মীরা নায়ারের ঘরে জন্ম নেন জোহরান কোয়ামে মামদানি। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় তার জন্ম হয়।

বাবা মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

মা মীরা নায়ারের নাম বিশ্বজুড়ে মানুষের মুখে মুখে। তিনি 'সালাম বম্বে' ও 'মনসুন ওয়েডিং'সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমার পরিচালক।

জোহরান মামদানির শৈশব কাটে কেপটাউনে। এরপর সাত বছর বয়সে যান নিউইয়র্কে। ব্রংক্স হাই স্কুল অব সায়েন্স ও ব্যাংক স্ট্রিট স্কুল অব চিলড্রেনে পড়ালেখা করেন। ২০১৪ সালে বাউডুইন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক নেন তিনি।

কলেজে পড়ার সময় তিনি 'জাস্টিস ফর প্যালেস্টাইন' সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

আরব নিউজের প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৭ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মেয়র প্রার্থী খাদের আল ইয়াতিমের নির্বাচনী প্রচারণায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন জোহরান মামদানি।

জোহরানের মতো খাদের জয়ী হলেও ইতিহাস সৃষ্টি হোত। তিনিই হতেন প্রথম আরব-ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মেয়র।

নিউইয়র্ক টাইমস জোহরান মামদানিকে 'ইসরায়েল সরকার ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের আচরণের' সরব সমালোচক হিসেবে অভিহিত করেছে। ২০২৩ সালে তিনি পশ্চিম তীর ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের সঙ্গে নিউইয়র্কের যেসব দাতব্য সংগঠনের যোগসূত্র আছে, তাদের কর-রেয়াত সুবিধা বাতিলের বিল উত্থাপন করেন। সে সময় জোহরান বলেন, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।

তিনি একাধিকবার গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছেন। বিডিএস (বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশানস) উদ্যোগের সমর্থক। বিডিএস উদ্যোগের দাবি ছিল ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে কাজ করা সংগঠনগুলোকে বর্জন, সেগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জোহরান 'জায়নবাদ-বিরোধিতা' ও 'ইহুদিবিদ্বেষের' মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজনের বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে তার বক্তব্যে তুলে ধরছেন।

ইসরায়েলবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থি বক্তব্যের কারণে বাইডেনপন্থি ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভরাডুবির পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে।

এর আগে, বৈশ্বিক শহর লন্ডনের প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন পাকিস্তান-বংশোদ্ভূত সাদিক খান। তিনি ২০১৬ সাল থেকে এই মহানগরীর মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। লেবার পার্টির এই সদস্য ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে