গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি পুনর্বিবেচনার পথে ভারত। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত এই ঐতিহাসিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে।
এরই মধ্যে চুক্তির শর্ত পুনর্মূল্যায়নের ইঙ্গিত দিয়েছে নয়াদিল্লি। ভারত সরকারের এই অবস্থানকে কেন্দ্র করে চরম উদ্বেগে পড়েছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তির শর্তে পরিবর্তন এলে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেকের আশঙ্কা, বাংলাদেশ যেন পাকিস্তানের মতো জলসংকটের মুখোমুখি না হয়।
চুক্তির পটভূমি
১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে গঙ্গার পানি নির্দিষ্ট হারে বাংলাদেশে ছেড়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ভারতের। ওই সময় এই চুক্তিকে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এক শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হিসেবে দেখা হয়েছিল।তবে ভারতের দাবি, উত্তর ভারতের কৃষি চাহিদা বৃদ্ধি, হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষা এবং পানি নিরাপত্তা সংক্রান্ত কৌশলগত চিন্তার কারণে নতুন করে স্বল্পমেয়াদি ও নমনীয় চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে।
ভারতের অবস্থান ভারতের কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোতে সেচের পানির চাহিদা ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া হুগলি নদীর শিলতলাকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘পানি অস্ত্র’ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার পর ভারতের পদক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—পানি এখন কূটনৈতিক কৌশলের অংশ।
বাংলাদেশের উদ্বেগ বাংলাদেশের একাধিক পরিবেশ গবেষণা বলছে, শুষ্ক মৌসুমে দেশের ৮৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ হয় গঙ্গা তথা পদ্মা নদীর মাধ্যমে। ফারাক্কা ব্যারেজে পানিপ্রবাহ কমলে এর প্রভাব পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে—খাল-বিল শুকিয়ে যায়, নদীর মোহনায় লবণাক্ততা বাড়ে, জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে।
২০২১ সালে ইউনেস্কো প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন ও মাছ ধরা কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ভারত চুক্তির শর্ত পুনরায় নিজের অনুকূলে আনতে চাইছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কি পাকিস্তানের মতো? বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের তথ্য অনুসারে, ভারতের জলসংরক্ষণ সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, গঙ্গার পানির বড় অংশ ভারত যদি নিজেদের কৃষি ও শিল্পের জন্য সরিয়ে নেয়, তবে বাংলাদেশের জন্য তা হবে একটি ভয়াবহ সংকট—যা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার মতোই জলাবদ্ধতা ও কৃষি ধসের দিকেই নিয়ে যেতে পারে।
কী হতে পারে সমাধান? বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা, সেচ আধুনিকীকরণ ও জল সংরক্ষণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গঙ্গার পানি শুধু দুই দেশের সম্পদ নয়—এটি এই অঞ্চলের টিকে থাকার অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎস। তাই একে নিয়ে বৈরিতা না করে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে টেকসই সমাধানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি। কলকাতা ২৪