বাংলাদেশ প্রতিনিধি
অসহায় পুলিশ
বেড়েছে নানা অপরাধ
সাখাওয়াত কাওসার
সারা দেশে বাড়ছে নানা অপরাধ। চাঁদাবাজি, দখল, ছিনতাই, মব জাস্টিস, সাইবার ক্রাইম, প্রতারণা, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে দেশের মানুষ শঙ্কিত। কোনোভাবেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সীমিত সামর্র্থ্য দিয়ে পুলিশ চেষ্টা করলেও অনেক ক্ষেত্রে এ বাহিনীর সদস্যরা অসহায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামান্য অপরাধেও মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে মানুষের অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির অভাব এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন তাঁরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পুলিশ একটা ট্রমার মধ্যে ছিল। এখনো পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটাই উন্নতির দিকে। ছিনতাই বেড়েছে। তবে ছিনতাই-ডাকাতি রোধে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জনমনে স্বস্তি ফেরাতে কমিউনিটি পুলিশকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।’
১ জানুয়ারি রাত দেড়টার দিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢাকা থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে নিজ বাড়ি ফেরেন হাসিবুল ইসলাম (৪০)। বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করানোর পরপরই ৮-১০ মাদকাসক্ত কিশোর গাড়ির ভিতরে তাঁর স্ত্রী, শ্যালকের স্ত্রীকে দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি শুরু করে। বাধা দিতে গেলে তারা হাসিব এবং তাঁর শ্যালক হানিফ ও গাড়িচালক শিমুলের ওপর হামলে পড়ে। জীবন রক্ষায় বাড়ির ভিতর ঢুকেও বাঁচতে পারেননি হাসিব। ২২ জানুয়ারি মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে রুবেল (৩২) নামে এক যুবককে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল জাদুরানী বাজারের একটি বট গাছে দুই হাত বেঁধে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তার দেহ নিথর হয়ে পড়ে। গুরুতর অবস্থায় হরিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রুবেল স্থানীয় গোগর গ্রামের পটুয়াপাড়ার মো. খলিলের ছেলে।
কেবল ওপরের দুটি ঘটনা নয়। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। খোদ রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকায় সাম্প্রতিককালে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া হালে জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আবারও তৎপর হয়ে পড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে সারা দেশে ডাকাতি, চুরি, দস্যুতা, সিঁধেল চুরির মামলা বেড়েছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ডাকাতি মামলা বেড়েছে ২০টি। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর ও নভেম্বরে বেড়েছে আরও বেশি।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বড় অস্বস্তি তৈরি করেছে ছিনতাই। যত্রতত্র ছিনতাই হচ্ছে। পুলিশ ও ঢাকার আদালতের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ৫০ থানা এলাকায় ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিনে অন্তত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছেন। এ সময় একজন ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন। গুরুতর জখম হয়েছেন আরও চারজন। ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হয়েছেন সাতজন। ১৮ ডিসেম্বর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হন কামরুল হাসান। ১৫ ডিসেম্বর মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামে এক তরুণ ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। গত বৃহস্পতিবার রাতে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ এলাকায় সজল রাজবংশী নামে ব্যবসায়ীকে গুলি করে প্রায় ৭০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাইয়ে অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তরাও কিশোর বয়সি।
এদিকে, ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগে দুটি পেজ পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। বৃহস্পতিবার ঢাকার শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন। এর আগে ১১ জানুয়ারি একটি পেজ থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন এমন গুজব ছড়ানো হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘সাধ্যানুযায়ী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্যও আমাদের বিশেষায়িত টিম কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত প্যাট্রোলিং করা হচ্ছে সাইবারজগৎ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি অপরাধের সঙ্গে যারা জড়াচ্ছে তার বেশির ভাগই তরুণ বা কিশোর। তারা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি কিংবা মব জাস্টিস বা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কারও কোনো আচরণ পছন্দ না হলে কিংবা আগের অভিযোগ বা ক্ষোভ থেকে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিতে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান না দেখানোয় সমাজে জটিলতা তৈরি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের ভাষা, চাহিদা বা আশা-আকাক্সক্ষা গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্তমান ও আগামী রাজনীতির বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। জনগণ যখন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাবে তখন এ ধরনের গুজব অনেকটাই কমে যাবে।’
আমাদের সময়
রাজনীতিতে বাড়ছে পারস্পরিক অনাস্থা
মুহম্মদ আকবর
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে সম্প্রতি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিবের মন্তব্য; এর জেরে তথ্য উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট এবং এরও পরে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের পাল্টা মন্তব্য ঘিরে চলছে নানারকম আলোচনা-পর্যালোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে করে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়ায় যে ফাটল রয়েছে, সেটি আরও স্পষ্ট হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের সহযোগিতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে বলে যে গুঞ্জন চলছে, সেই গুঞ্জন এই ফাটলকে আরও বড় করছে। বিশ্লেষকদের মতে, হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সম্প্রতি একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস, অনাস্থা বাড়ছে।
বিএনপিসহ বেশকিছু দল যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের ওপর বরাবরই গুরুত্বারোপ করে আসছে। এ বিষয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের সঙ্গে দাভোসে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জানান, নির্বাচনের সময়কাল নির্ভর করবে দেশের জনগণের প্রত্যাশার ওপর। মানুষ যদি দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে।
সরকারের ভেতর থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, যদি ছাত্ররা সরকারের ভেতরে থেকে দল গঠন করে, তাহলে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে। ছাত্ররা দল গঠন করবে, খুবই ভালো কথা। আমরা তারুণ্যের শক্তিকে স্বাগত জানাব। কিন্তু কিংস পার্টি গঠন হলে ছাত্রদের আদর্শটা থাকে না। এটা হবে খুবই অপ্রত্যাশিত। এতে পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাবে এবং ক্ষতি হবে এই অভ্যুত্থানের।
দিলারা চৌধুরীর ভাষ্য, দল গঠন করলে আগে তাদের সরকার থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তারা অভ্যুত্থান করেছে খুব ভালো কথা। আমিও এই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের সঙ্গে অনেক কর্মসূচিতে ছিলাম, এখনও তাদের সঙ্গেই আছি। কিন্তু সরকারে থেকে নতুন পার্টি গঠন করলে অভ্যুত্থানের আদর্শ নষ্ট হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধ আরও স্পষ্ট হতে থাকবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধগুলোও তত স্পষ্ট হতে থাকবে। যার-যার স্বার্থের বিষয়ে রাখঢাক সরে যাবে। বিএনপি যদি দেখে, সামনের নির্বাচনে ছাত্ররা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাহলে তারা ছাত্রদের ছাড় দেবে না। এটাই স্বাভাবিক। এটাই রাজনীতি। অন্যদিকে ছাত্ররাও দেখছে, তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বিএনপি। তাই তারা বিএনপির ব্যাপারে কথা বলছে। সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, এক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। তার এ আশঙ্কার সঙ্গে আমি একমত। আমি মনে করি, এ সরকার সামনের দিনগুলোতে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলে নির্বাচন আয়োজনের যোগ্যতা হারাবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্দলীয়। এটি সাময়িক একটা সরকার। ফলে বিশেষ কোনো দল, আদর্শ বা গ্রুপের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ তাদের নেই। যদি দেখা যায়, বিশেষ কোনো মহল, ছাত্র, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন থাকে, তাহলে সরকারের নিরপেক্ষ চরিত্র থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা দূরত্ব সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার সরকারের।
সাইফুল হক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, গাছেরটা খাও আবার নিচেরটাও কুড়িয়ে নাওÑ এমন সুযোগ নেওয়া ঠিক হবে না। এতে সরকারের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস কমে যাবে এবং তরুণ প্রজন্মের মনে ছাত্রদের সম্পর্কে যে সম্ভাবনার স্বপ্ন রয়েছে, শুরুতেই তা হোঁচট খাবে। তিনি যোগ করেন, সম্প্রতি ছাত্রদের মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ। তরুণদের কথাবার্তায় প্রজ্ঞার পরিচয় প্রত্যাশা করেন এই রাজনীতিক। এও বলেন যে, কোনোভাবেই চাইব না ছাত্রদের সঙ্গে, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব বেড়ে যাক।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার দরকার। সুতরাং অল্প ও বেশি সংস্কার নিয়ে আলোচনা করাটা অবান্তর। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে আগামী ৭-৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব, মন্তব্য তার।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিএনপি মহাসচিব বলেছেন সরকারের নিরপেক্ষতা যদি ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ সরকারের দাবি তুলবেন। অপরদিকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, সরকারের কেউ যদি রাজনৈতিক দলে যুক্ত হয় তাহলে তিনি সরকারে থাকবেন না; পদত্যাগ করবেন। এখানে তো আমি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ দেখি না।
মঞ্জু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীরা যেহেতু একটা দল গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটা নিয়ে একটু তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। আমি এটাকে গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখি। তিনি বলেন, বিএনপি হলো বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী সবচেয়ে বড় দল, মির্জা ফখরুল সেই দলের অন্যতম শীর্ষজন। আর উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের অন্যতম প্রধান নেতা। ফ্যাসিবাদের পতনের পর এই দুজন, তাদের কমিউনিটি বা দল সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাই অল্পস্বল্প দ্বিমত থাকতেই পারে, বিতর্কও হতে পারে। এমন বিতর্কের কারণে আপাতদৃষ্টিতে উভয়পক্ষের মধ্যে একটু দূরত্ব বা উদ্বেগ তৈরি হলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ বা অনৈক্য হবে না বলেই আমি মনে করি।
কালবেলা
নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির দুই ‘না’ এক ‘হ্যাঁ’
শফিকুল ইসলাম
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে রাজনীতির উত্তাপের পারদ। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের নিত্য বাহাসে নানামুখী কৌতূহলের জন্ম নিচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল গঠন, দীর্ঘ সময় নিয়ে না দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা গণপরিষদ গঠন—এসব নিয়েই চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে থাকলেও এখন সেটা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। সরকারের একটি অংশ ও রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সব পক্ষই শুরু করেছে নির্বাচনী হিসাবনিকাশ।
শুধু নির্বাচন নয়, অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও মূলত নির্বাচন ঘিরেই ব্যস্ত রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা। এসবের মধ্যে দুটি বিষয়ে বিএনপির মনোভাব নেতিবাচক বা না বলে দিয়েছে। একটি বিষয়ে দলটি ইতিবাচক বা হ্যাঁ। যে দুটি বিষয়ে বিএনপি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে তা হলো, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ করা যাবে না এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা যাবে না। তবে নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। অবশ্য বিএনপির শীর্ষ মহল বলছে, ‘নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হলে ওই দলে যারা নেতৃত্বে থাকবেন, তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন না। ছাত্রদের প্রতিনিধি সরকারে অন্তর্ভুক্ত থেকে নতুন দল গঠন করা হলে সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। বিএনপির এসব ইস্যুতে একাধিক ইসলামী দলসহ সমমনা দলগুলোও একই মত পোষণ করছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করেই চলতি বছরের মাঝামাঝি অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তার অনেক সুপারিশই দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সরকার দরকার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওইসব সংস্কার প্রস্তাব ১০ বছরেও সম্পন্ন করা যাবে না। এ ছাড়া তারা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
এদিকে, জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। এ ক্ষেত্রে সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি মানবে না। অর্থাৎ সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দল গঠন করা উচিত হবে না বলেও বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল মনে করে। বিএনপির একাধিক নেতা কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায় হলেও জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে তাদের ‘দোসর’ হিসেবে পরিচিত ও আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা বহাল আছে। তাদের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে হলে অবশ্যই সব পক্ষের নিরপেক্ষ ভূমিকা থাকতে হবে। সেজন্য একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথাও সামনে এনেছে বিএনপি। অর্থাৎ সরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে তারা নির্বাচন পরিচালনা পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। নিরপেক্ষ ও নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনেও যেতে পারে বিএনপি।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ভাষ্য, ‘আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে; পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।’ কেননা, ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট যাতে আসতে না পারে, সেরকম সংস্কার নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু বিএনপি চাচ্ছে ক্ষমতায় এসে নিজেদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের পদগুলো কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টায় আছে। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। এরই মধ্যে নিরপেক্ষ সরকার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থানকে আরেকটা ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার’ গঠনের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। গত বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে তিনি ওই অভিমত ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি বিএনপির দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী নেতৃত্বকে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে না গিয়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির পথ বেছে নেওয়ার আহ্বানও জানান নাহিদ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে এমন কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না, যা উভয়পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়। পরস্পরের মতামতকে সম্মান ও গুরুত্ব দিয়ে কথা বলা উচিত।
জানা গেছে, ‘গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ থেকে ২০২৬ সালের প্রথম দিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছে।
গত ১৪ জানুয়ারি দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আমরা সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ছিল, এই বছরের শেষের দিকে অথবা পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে; এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, নির্বাচন এত বিলম্বিত করার যৌক্তিক কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হচ্ছে। বারবার বলছি, সংকট সমাধানে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে; দেশে মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। তাই দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। এখন দেশ ও জাতির পুরো ফোকাসটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় মানুষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে উত্তরণের পথ সুগম করতে চায়। স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না। দেশ চালায় জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ, গণতন্ত্রের মূল বিষয় ও ভিত্তি হচ্ছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ। সংসদ কার্যকর হলে গণতন্ত্র কার্যকর হয়।’
এদিকে, বিএনপির ওই সংবাদ সম্মেলনের পরপরই পৃথক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’ বিএনপি জুলাই-আগস্টে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ আমার নেই। আমাদের প্রস্তুতি হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা যে ‘উইনডো’ দিয়েছেন সেই আলোকে কাজ করা।”
নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘গত পাঁচ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিদের পদ বাতিল করেনি। কাজেই এখানে যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে, তা কি ইউনিয়ন পরিষদ বাদ দিয়ে তার ওপরের দিকে? পৌরসভা বলুন, উপজেলা বলুন, সেটা তো আরও ওপরে। কাজেই একদম তৃণমূলের যে লোকাল গভর্নমেন্ট, সেটা তো ইউনিয়ন পরিষদ, সেটা যদি বাতিলই না করা হয়ে থাকে, তবে এখানে নির্বাচন কীভাবে সম্ভব? বাস্তবতা হচ্ছে প্রথমে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। পরে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে, তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না কালবেলাকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার করেও দ্রুততম সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব। এজন্য আমরা কোনো চাপ দিচ্ছি না। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার সেগুলো আমরা বলবে, পরামর্শ দেব। সরকার নির্বাচনের যে সময় জানিয়েছে, তাতে কোনো সমস্যা দেখছি না।’
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, ‘বিগত ৫৩ বছর আমরা চড়াই-উতরাই পার করেছি। ১/১১ পূর্ববর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণ তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিল। তাই আমরাও মনে করি, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা চলতে থাকবে। আমরা একটি নির্বাচিত প্রাণবন্ত সংসদ গঠন করতে চাই। আওয়ামী লীগের মতো ব্যালট চুরি করে দিনের ভোট রাতে করা, নির্বাচন ছাড়া এমপি করা—এসব দেশের মানুষ কখনোই গ্রহণ করেনি।’ মিল্টন বলেন, ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারাই ক্ষমতায় আসবে তারাই সংস্কার বা দেশ গঠনের অন্যান্য কাজ করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া।’
বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া শুক্রবার কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি বলেছেন যে, এই বছরের শেষ দিক থেকে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে এটি নির্ভর করছে আসলে কী পরিমাণ সংস্কার মানুষ চায় তার ওপর। চারটি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে। বাকি কমিশনগুলোও প্রতিবেদন দেবে। এগুলো নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কমিশনের প্রতিবেদন কতটুকু গ্রহণযোগ্য ও কতটুকু কবে বাস্তবায়নযোগ্য, সেটি নির্ধারণ করা হবে।’
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি কাঠামোগত সংস্কার মানুষের প্রত্যাশা। এর পরই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত। এই সময়ের মধ্যে আমরা প্রত্যাশা করব সব অংশীজন সহযোগিতা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেই জায়গা থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন আয়োজনের পরে ভবিষ্যতে যে কোনো জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক। এটা নাগরিক হিসেবে আমারও চাওয়া।’
এদিকে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নতুন সংবিধান রচনা করার পর নির্বাচন চায় জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ শুক্রবার কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে, ভারতের সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যের পরদিনই বিএনপি কর্তৃক দ্রুত নির্বাচনের দাবি একই সূত্রে গাঁথা।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন পক্ষ থেকেও চাপ দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন দরকার। তারা কোনো সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন চায়। আজ হঠাৎ করে বিএনপি আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে, এর আগে তারা ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে। এই দুটির মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি। ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিএনপি এটা চাচ্ছে। এটা সবার কাছে পরিষ্কার।’
হান্নান মাসউদ আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট যাতে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে না পারে; জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে—সেরকম সংস্কার নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নতুন একটি গণপরিষদ ও নতুন সংবিধান রচনার মাধ্যমেই সম্ভব বাংলাদেশে নতুন করে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকানো।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হান্নান মাসউদ বলেন, ‘বিএনপি চাচ্ছে ক্ষমতায় এসে নিজেদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে, যা এটাকে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে এগোনো সম্ভব।’
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার যেহেতু নির্বাচিত নয়, সেহেতু তাদের ম্যান্ডেট পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। দলগুলোকে বোঝাপড়ায় আনতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মতামতের ভিত্তিতেই ন্যূনতম ভারসাম্যের মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যেমন আছে, তেমনি বৈষম্যবিরোধীদেরও জাতীয় সরকারের দাবি ছিল। জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাই বলি না কেন, এই ইস্যুতে তাদের দাবি কিন্তু কাছাকাছিই ছিল। এ বিষয়ে কথাবার্তা বলেই তো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব। সব পক্ষ থেকে বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করতে হবে। বিএনপি তো সরকারকে শুরু থেকেই নিরঙ্কুশ সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তারা চাইলেই সরকারে বড় ধরনের সুবিধাও নিতে পারত। বিএনপিও কিন্তু আন্দোলনের বড় স্টেকহোল্ডার। জুলাই আন্দোলনে তাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সবাই মিলেই তো একটা আন্দোলন, একটা বিপ্লব। এ ক্ষেত্রে নিজেদের ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকলে তো অন্যরা সুযোগ নেবে—এটাই স্বাভাবিক।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কি মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাব এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবে না। প্রার্থী হতে পারবে না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ছিল? তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেননি। তিনি নিজের অধীনে নির্বাচন করেছেন। এখন তো আপনি এমন কিছু করতে পারবেন না যে, আপনি নির্বাচন পরিচালনা করবেন; আর আপনার দলও নির্বাচনে অংশ নেবে। এই একই কাণ্ড হলে ১৫ বছর কেন আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। আমরা ১/১১ বুঝি না, সব দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অতিদ্রুত একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। যে অভিযোগ আমরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তুলেছিলাম, সেই অভিযোগ যেন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে না ওঠে। সব রাজনৈতিক দলের জন্য সরকারকে সমান সুবিধা বা লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’
যাযাদি/ এসএম