৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সরকারি তালিকায় ভয়াবহ জালিয়াতি এবং প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। 'জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন' সরকারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছে, বহু ব্যক্তি ভুয়া মেডিকেল ডকুমেন্ট ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এটি কেবল হতাহতদের প্রতি অবিচার নয়, বরং শহীদদের আত্মত্যাগ এবং জাতীয় গণ-আন্দোলনের প্রতি চরম অবমাননা বলে উল্লেখ করেছে ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশনের মতে, এই প্রক্রিয়া ছিল দুর্বল, অবহেলাপূর্ণ এবং ত্বরিত রাজনৈতিক চাপের ফল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যারা জুলাই অভ্যুত্থানে কোনোভাবেই অংশ নেননি, এমনকি আহতও হননি, তাদের নামও এমআইএস তালিকায় ঢুকে পড়েছে।
প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তাদের ফাইল বিশ্লেষণে অসংখ্য ত্রুটি, প্রতারণা এবং জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে। যেমন:
অ-আন্দোলনকারী আহত: অনেকে আন্দোলনে আহত না হয়েও পরবর্তী সময়ে কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়ে নিজেদের 'জুলাই যোদ্ধা' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিরাও এই সুযোগ নিয়েছেন।
চাটখিলের অস্ত্র লুণ্ঠনকারী: নোয়াখালীর চাটখিল এলাকার মো. ইমতিয়াজ হোসেন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী ছিলেন। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর থানা লুট করতে গিয়ে লুণ্ঠিত অস্ত্র অসাবধানতাবশত নিজের পায়েই গুলি করে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। তাকেও 'শহীদ' হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে (গেজেট নম্বর ৭৮৪)।
চাঁদাবাজির শিকার: ঢাকার ডেমরা থানার আবু সাইদ গত বছরের ৯ আগস্ট চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন। আশ্চর্যজনকভাবে, তার নামও শহীদদের তালিকায় (গেজেট নম্বর ১৭৯)।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু: যাত্রাবাড়ীতে ১৩ আগস্ট পরাটা আনতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বিজয়ও 'শহীদ' হিসেবে তালিকাভুক্ত।
পারিবারিক বিরোধে খুন: পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে গুলিতে নিহত আল আমিনও শহীদদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তার বাবা এ বিষয়ে ওয়ারী থানায় হত্যা মামলাও করেছেন।
প্রশাসনের দুর্বলতা ও আইনি পদক্ষেপ
জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের নাম এমআইএস তালিকায় তোলার আগে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সরকার গঠিত গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল কর্তৃক যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও, বাস্তবে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বল ছিল। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসাইন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, "আমরা যাচাই-বাছাই করে ১৯ জনের নাম এমআইএস তালিকা থেকে বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছি। এ পর্যন্ত ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শহীদ এবং জুলাই আহতদের তালিকায় স্থান পাওয়া ৭০ জনের বেশি আমরা শনাক্ত করেছি। এদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চলমান আছে। আবার অনেকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।"
গুরুত্বপূর্ণ দুটি মামলার দৃষ্টান্ত
প্রতারণার দুটি নির্দিষ্ট ঘটনা শাহবাগ থানায় চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল করা ১১ নম্বর মামলায় উঠে এসেছে:
ইলিয়াস হোসেন হিরণ: উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের মো. ইলিয়াস হোসেন হিরণ গত বছরের ৭ আগস্ট পূর্ব শত্রুতার জেরে হামলায় আহত হয়েও ভুয়া মেডিকেল ডকুমেন্টস জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেকে 'জুলাই যোদ্ধা' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন এবং সরকারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার চেক নেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। মো. লিটন: মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদের মো. লিটন ১৪ জুলাই রাজু ভাস্কর্যের সামনে বা বিজয় ৭১ হলের সামনে আহত হওয়ার ভুয়া দাবি করে প্রতারণা করে জুলাই আহত যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। জাল কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
উল্লেখ্য, এই দুজন— মো. লিটন এবং ইলিয়াস হোসেন হিরণ— উভয়ের নামই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস তালিকায় 'ভেরিফাইড' দেখাচ্ছে।
দায় কার?
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান শাহিদ গণমাধ্যমকে বলেন, "জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে যারাই যেভাবে আহত হয়েছেন, তারা যখন দেখলেন আন্দোলনে আহতদের বাড়তি চিকিৎসা এবং সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তখন তারাও নিজেদের আহত বলে দাবি করে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। সে সময়ে অনেক বেশি মানুষ হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ছিলেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সেগুলো যাচাই বাচাই করতে পারেনি। যারাই বলেছেন আন্দোলনে আহত তাদেরই এমআইএস করে দিয়েছে।"
শাহিদ আরও জানান, ফাউন্ডেশনের প্রথম দিকে দ্রুত আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার চাপের কারণে সূক্ষ্মভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তিনি একটি 'ফ্রড ডিটেকটিং টিম' গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা দিয়ে এক থেকে দেড় হাজার ভুয়া আহত ব্যক্তি চিহ্নিত করা সম্ভব বলে তার ধারণা।
গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা (যুগ্মসচিব) মো. মশিউর রহমান জানান, শহীদদের তালিকা নিয়ে খুব বেশি আপত্তি না থাকলেও, আহতদের তালিকায় 'বেশ সংখ্যক আপত্তি' রয়েছে। অভিযোগ পেলেই তারা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দেন।
এই ব্যাপক প্রতারণা এবং জালিয়াতির ঘটনা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রকৃত শহীদ ও আহতদের প্রতি চরম অন্যায় এবং সরকারের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার দুর্বলতাকেই স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।