শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা ছিল- যিনি প্রকৃত ধার্মিক, তিনি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। অন্য ধর্ম ও মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন তার পারিবারিক ঐতিহ্য।
সাজ্জাদুল হাসান
  ১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১০:২১

১৫ আগস্ট জাতির কালিমালিপ্ত; বেদনাবিধুর শোকের দিন- জাতীয় শোক দিবস। মানুষের কথা, দেশের কথা বলা; একটা জাতির মুক্তি ও একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু এ দেশের কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে নিহত হন। খুনিরা ভেবেছিল, তার মৃতু্যর মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ; তার রাজনীতির দর্শন ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক 'মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রম্ন তোমার' কবিতায় তাই লিখেছেন- 'মুজিব মরে না, মরেনি মুজিব কোনো বুলেটের ঘায়। বুলেটে পতিত দেহই কেবল, অমর সে আত্মায়।/মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রম্ন তোমার, আজও এই বাংলায়/কুটিরে পাথারে নগরে ও গ্রামে পায়ে পায়ে হেঁটে যায়-/অবিরাম হেঁটে চলেছে মুজিব রক্তচাদর গায়।/মুজিব! মুজিব! জনকের নাম এত সহজেই মোছা যায়!' বস্তুত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ব্যাপকতার কারণেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র যতদিন থাকবে, তার প্রাসঙ্গিকতা মুছে ফেলা যাবে না। শুধু একটি দিক নিয়ে যদি বলি, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাধনার অন্যতম আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। এ আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ যুদ্ধ করেছিল একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্র্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা ছিল ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুমহান চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের কোনো সংঘাতের ঠাঁই ছিল না। জীবনদর্শনে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় শেখ মুজিব বাংলার চারটি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সবাইকে সমদৃষ্টিতে দেখতেন। তার ৬ দফা হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে ধর্মীয় বিরোধ উপেক্ষা করে ৭০-এর নির্বাচনে এক অবিশ্বাস্য ফলাফল নিয়ে আসে এবং সেখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত পটভূমি রচিত হয়। ধর্মীয় বিরোধের কারণে যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব; তা রোধকল্পে তিনি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু মূলত ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিধানে অন্যসব ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা ছিল- যিনি প্রকৃত ধার্মিক, তিনি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। অন্য ধর্ম ও মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন তার পারিবারিক ঐতিহ্য। পারিবারিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই ধর্মীয় সংকীর্ণতা যেমন বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে পারেনি, তেমনি তার রাজনৈতিক জীবনেও কখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি স্থান পায়নি। ধর্মের ব্যবহার যাতে রাজনীতিকে কলুষিত না করে, সে জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে অসাম্প্র্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে জানতে পারি, কিশোর বয়সেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত হয়ে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৮ সালে, হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা চলাকালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় হিন্দু ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্তর্ভুক্তির অনাগ্রহ দেখে আশ্চর্য হন। তার ভাষায়, 'আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো- সবই চলত।' ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে সংঘটিত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দাঙ্গাবিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় বাংলাদেশের আইনসভায় নবীন সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন : 'আমরা ধর্মাচরণ বন্ধ করব না... মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... আমাদের আপত্তি শুধু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে।' ইংল্যাল্ডে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্র আয়োজিত এক বক্তৃতায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন- 'শেখ মুজিবের চিন্তা ও বিচার এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম অগ্রনায়ক। এ বিষয়ে তিনি যে উদাহরণ তৈরি করেছেন, সেখান থেকে ভারতসহ অনেক দেশই শিক্ষা নিতে পারে।' বঙ্গবন্ধু তার অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বিভিন্ন বক্তব্য বা বিবৃতিতে শুধু প্রকাশ করতেন; তা নয়। তার জীবনাচরণেও তিনি তা ধারণ ও লালন করতেন। অনেক ঘটনার মধ্যেই তা প্রমাণিত। এর মধ্যে একটি ঘটনা বলা যাক। গোপালগঞ্জের ত্যাগী সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর দেখা হওয়ার ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থে। গুরুতর অসুস্থ চন্দ্র ঘোষকে অপারেশনের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি তখন তাকে দেখতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে দেখতে গেলেন। চন্দ্র ঘোষ কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, 'ভাই, এরা আমাকে 'সাম্প্রদায়িক' বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই।' কথাগুলো শুনে সবার মতো বঙ্গবন্ধুর চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। তখন তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, 'চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নেই। সকলেই মানুষ।' অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ এমন ঘটনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ক্ষমতার পালাবদলে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিলাষে তা বিভিন্ন সময়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সর্বস্তরের মানুষ এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার কঠোরভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশাবাদী এ জন্য, তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সে আদর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাও অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী। পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণের 'কোথায় তুমি নেই' কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছি- 'কোথায় তুমি নেই?/তোমার ছবি প্রেমের মতো/ মুক্ত ভুবনেই।/ তোমার ছবি মৃতু্যহীন ঐ/ কালের ইতিহাসে;/ সাগর জলে, নদীর জলে,/চোখের জলে ভাসে।' লেখক : চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স; সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে