রোববার, ০১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী: স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে রাষ্ট্রকাঠামো গঠন 

যাযাদি ডেস্ক
  ৩০ মে ২০২৫, ২০:১৬
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী: স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে রাষ্ট্রকাঠামো গঠন 
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ফাইল ছবি

আজ ৩০ মে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক ষড়যন্ত্রমূলক হামলায় জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফলে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ড গোটা জাতির জন্য ছিল এক গভীর শোকের দিন, যা বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারাকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। দেশ এক সংকটময় মুহূর্তে ফিরে গিয়েছিল, আর জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের পথ অনেকটাই থমকে গিয়েছিল।

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগাবাড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মনসুর রহমান এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। তিনি ১৯৫২ সালে করাচি একাডেমি স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং ১৯৫৩ সালে করাচির ডি.জে. স্কুলে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৫৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে সাহসী নেতৃত্ব দেন এবং বীরত্বের জন্য পুরস্কৃত হন।

1

১৯৭০ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রামে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ গণহত্যার পর যখন জাতি হতাশাগ্রস্ত, তখনই চট্টগ্রামে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা দেশের জনগণকে নতুন উদ্দীপনায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে। তিনি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় যুদ্ধের গতি আরও বেগবান হয়। জুন মাসে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে অসামান্য সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার এই অসামান্য অবদানের জন্য তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। তবে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবে তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং পুনরায় দেশের নেতৃত্বে আসেন।

জাতির ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দুটি সংকটময় সময়ে দেশকে পথ দেখিয়েছেন—প্রথমত, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে, এবং দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক দুরবস্থার পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেশের সার্বিক উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানে গণতন্ত্র হরণ করে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল, যা জিয়াউর রহমান বাতিল করে দেশের জনগণকে রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" ধারণার প্রবক্তা, যা ছিল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার একটি দূরদর্শী চিন্তা। এছাড়া তৎকালীন সময়ে গঠিত বাকশালকে আরো শক্তিশালী করার জন্য গুটি কয়েক পত্রিকা ছাড়া অন্যান্য পত্রিকা বন্ধ করার জন্য আইন করেছিল। জিয়াউর রহমান এই কালাকানুন বাতিল করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল।

তিনি প্রথম খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করেন যাতে কৃষকরা খরার সময় সেচ সুবিধা পায়। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি প্রদানসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে তিনি নানা পদক্ষেপ নেন। গ্রামীন শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণে "গ্রাম সরকার" প্রতিষ্ঠা, গণসাক্ষরতা কর্মসূচি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, যুব মন্ত্রণালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা তার visionary leadership-এর পরিচায়ক।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের স্বীকৃতি দিতে তিনি প্রথম “একুশে পদক” এবং “স্বাধীনতা পদক” প্রবর্তন করেন। তিনি বেসরকারি খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন, যার ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে গতি সঞ্চার হয়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী, আল-কুদস কমিটির সদস্য, ওআইসি-তে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ তার অসামান্য কূটনৈতিক অর্জন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠনের পরিকল্পনা তিনিই প্রথম গ্রহণ করেন, যা বাস্তবায়িত হয় ১৯৮৫ সালে।

আজকের বাংলাদেশের যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি, তার অনেকটাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী পরিকল্পনার ফসল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই মহান রাষ্ট্রনায়কের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে ঘাতকেরা হত্যা করে।

আসুন, আমরা এই দিনে শহীদ জিয়াউর রহমানের আত্মত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি— মহান আল্লাহ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শহীদি মর্যাদা দান করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন আমিন।

লেখক : সাইদুর রহমান সাঈদ , শিক্ষার্থী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে