বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আন্দোলনে একট্টা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত

যাযাদি রিপোর্ট
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:১১
আন্দোলনে একট্টা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত

দফায় দফায় আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর এবার একাট্টা আন্দোলনে নামার প্রয়োজনীতা অনুভব করছে বিএনপি ও জামায়াত। দ্বাদশ নির্বাচনের আগে একমঞ্চে থাকার পাশাপাশি দল দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ত না বলে উভয় দলের অনেক নেতা মনে করেন। সঙ্গত কারণে পরবর্তী আন্দোলন সফলে একসঙ্গে মাঠে নামার পরিকল্পনা হচ্ছে।

বিএনপি-জামায়াতের সখ্যতা ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় থেকে। তবে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক জোট গঠন হয় ১৯৯৯ সালে। তারপর থেকেই একসঙ্গে পথ চলছে বিএনপি-জামায়াত। চার দল দিয়ে শুরু হয়ে ২০ দল পর্যন্ত একসঙ্গে জোটের রাজনীেিতত থাকলেও দ্বাদশ নির্বাচনের আগে ২০ দলের বিলুপ্তি হয়। শুরু হয় যুগপৎ ধারার আন্দোলন। এই আন্দোলনে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ কর্মসূচির ঘোষণা না দিয়ে পৃথকভাবে কর্মসুচী পালন করে পরস্পরে দুরত্ব বজায় রাখার আভাস দেয়।

বিএনপি-জামায়াতের একাধিক সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতের শীর্ষ নেতারা একসঙ্গে আন্দোলন করার বিষয়ে আলোচনা করেছিল। তবে দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের একাংশ এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে বাধা দেয়। বিশেষ করে বিএনপির জামায়াত বিরোধী অংশ দলীয় ফোরামে বলেন, ভারত এবার ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অবস্থান নেবে না। দেশটির এই অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে জামায়াত যদি সরাসরি বিএনপির সঙ্গে থাকে। এজন্য দূরত্ব বজায়ের কৌশলী অবস্থানে থাকাই ভালো। বিষয়টি যৌক্তিক বিবেচনায় একমঞ্চে আন্দোলন করা হয়নি দল দুটির।

জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, ২৮ অক্টোবরসহ সরকারকে বেকায়দায় ফেলাতে প্রতিটি আন্দোলনে জামায়াত একসঙ্গে থাকার প্রস্তুাব দিয়েছিল বিএনপিকে। আন্দোলনের সময় সমন্বয়ের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, যুগপৎ ধারা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। এ ছাড়া আগেরবার অন্য দলের নেতার নেতৃত্বে নির্বাচন আর এবার দলের ওপর ভর করে আন্দোলনের তকমা লাগাতে চায় না বিএনপি। একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বিএনপির আন্দোলন সফলের জন্য অন্য দলের নেতাকর্মীর প্রয়োজন নেই।

অবশ্য বিএনপির মধ্য সারির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আন্দোলনের সময় জামায়াতের ভূমিকা সমমনা দলেও সমালোচনা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরে সমাবেশের দিনেও একদিকের কর্মসূচি অন্যদিকে শান্তিপূর্ণভাবে করার ঘটনাকে ঘিরে বিএনপিতে নানা সন্দেহও দেখা দেয়। ফলে পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে আন্দোলন করে এর নাটাইয়ের একটি অংশ অন্যদলের হাতে দিতে অনেকের আপত্তি ছিল।

নির্বাচন পরবর্তী সময়ও এর ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জানুয়ারির শেষদিকে তিনদিন সারাদেশে জেলা ও মহানগরে কালো পতাকা মিছিল করে বিএনপি। সমমনা দলের অন্য শরিকরা এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও জামায়াতে ইসলামি বিএনপিকে অনুসরণ করেনি। একই ইস্যুতে তারা একদিন পরে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়।

জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, বিএনপির পক্ষ থেকে একই দিনে একই কর্মসূচি দেওয়ার জন্য জামায়াতকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জামায়াত সেটি কৌশলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে না পারার জন্য জামায়াত বিএনপিকেই দায়ী করছে। তারা বলছে, নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে বিএনপি তৎপর ছিল না। নির্বাচনবিরোধী কর্মসূচির সবই পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপিকে রাজপথে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় জামায়াতের নেতাকর্মী পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। তারা এখন কারাবন্দি। এ অবস্থায় জামায়াত যুগপৎ আন্দোলনের চেয়ে দলীয় নেতাকর্মীর জামিনে মুক্ত করতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বিএনপি ও জামায়াত সূত্রমতে, নির্বাচনের আগে এক ধরনের অবস্থা থাকলেও এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলন বা নির্বাচনের স্টিয়ারিং সিটে কে থাকবে তা নিয়ে আর ভাবতে চায় না বিএনপি জামায়াতসহ সমমনা দলের নেতারা। সরকার হটানোকেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। এজন্য বিএনপি-জামায়াতসহ সব দল একমঞ্চ থেকে আন্দোলনে নামার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

সূত্রমতে, জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চের আন্দোলনে নামতে বাম ধারার দলগুলোর একসময় তীব্র আপত্তি ছিল। এখন সেই অবস্থা আর নেই। বাম ধারার দলগুলোও এখন আন্দোলন বেগবানকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই এবার সবদলকে একমঞ্চ থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে দেখা যেতে পারে। জামায়াতে সঙ্গে এখনই একমঞ্চে আন্দোলন করার বিষয়ে দল দুটির দায়িত্বশীল পর্যায়ের কোনো নেতা সরাসরি কিছু না বললেও দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্দোলন বেগবান করার আভাস দিয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশের গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত না, সমাহিত। এ অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যারা সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী তারা দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আর ভোটাধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে আসবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মনের ঐক্য হয়ে গেছে।

একই বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের নামে ক্ষমতা জবরদখলকারীরা দেশ ও জাতির সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা প্রযুক্তির কল্যাণে সবার সামনে এসেছে। এ অবস্থায় দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী সরকারের পতনের লক্ষ্যে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

প্রসঙ্গত, জামায়াত ও বিএনপির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। জামায়াত ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর সেই নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল। এরপর থেকে দল দুটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ৯৯ সালের শুরুতে এসে আনুষ্ঠানিক জোটে রূপ নেয়। তখন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। এই জোটই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পান জামায়াতের দুই নেতা- মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ। তারা দুজনই পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটও পরে বিশ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ২০১৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াতও সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে। আবার ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব বিএনপিসহ কয়েকটি দল যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছিল সেখানে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন জামায়াত দলীয় প্রার্থীরা। অন্যদিকে ২০১৩ সালের নয় ফেব্রুয়ারির পর প্রায় এক দশক ঢাকায় কোনো সমাবেশের অনুমতি পায়নি জামায়াত। দীর্ঘ এ বিরতির পর গত বছর ১০ জুন ঢাকায় দলটি সমাবেশের আয়োজন করে আলোচনায় আসে। মূলত ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে যায়।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে