বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসছে বড় রদবদল

সন্জীব নাথ, চট্টগ্রাম
  ২৫ জুন ২০২৪, ১০:৪৮
-ফাইল ছবি

আগামী অক্টোবরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বহু প্রতীক্ষিত ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। এ ঘোষণার পর থেকে আসন্ন কমিটিতে শীর্ষস্থান পেতে পদপ্রত্যাশী নেতারা যে যার মতো তদবির শুরু করেছেন। কেউ কেউ সম্পর্ক অধিকতর গভীর করে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে। পাশাপাশি নানাভাবে তৎপর শেষ মুহূর্তে দলীয় প্রধানের আস্থা অর্জনে।

২০০৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সভাপতি এবং আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি কেন্দ্র থেকে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর কেন্দ্র থেকে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত পরে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটির প্রথম সহ-সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরীকে। এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে সাড়ে সাত বছর আগেই। ২০২২ সালে তিন বার ও ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও সম্মেলন হয়নি। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন কারণে আর সম্মেলন হয়নি। অবশেষে আগামী অক্টোবরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে লক্ষ্যে গত মে মাস থেকে শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা কমিটির সম্মেলন। এসব সম্মেলনে নতুন নেতৃত্বও নির্বাচন করা হবে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী।

তিনি বলেন, অক্টোবরে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন। তার আগে আমাদের তৃণমূলের যেসব কমিটির সম্মেলন বাকি আছে তা শেষ করা হবে। চট্টগ্রাম মহানগরের অধীনে ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩২টি ইউনিট আছে। এরই মধ্যে ১০৫টি ইউনিটের সম্মেলন এবং নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। বাকি ২৭টি ইউনিটের সম্মেলন শুরু হবে। সেই সঙ্গে ৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টির সম্মেলন হয়েছে। বাকি ১৯টির সম্মেলন হবে। এ ছাড়া ১৫টি সাংগঠনিক থানার সম্মেলনও হবে। সম্মেলনকে সফল করতে গঠন করা হবে বিভিন্ন উপ-কমিটি।

আগামীতে কে হতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ্যেও কৌতূহলের শেষ নেই। নানা জলপনা কল্পনার পাশাপাশি চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আগামী অক্টোবরে সম্মেলনের পর কেন্দ্র থেকে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহীরা কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে জোর লবিং শুরু করেছেন। দলীয় নেতাদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ড নানা সূত্রে দলীয় সভানেত্রীর টেবিলে জমা হচ্ছে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও অসুস্থতার কারণে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তার মতো কমিটির আরও অনেকে অসুস্থ। কেউ কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অনেক নেতা মারাও গেছেন। কেউ কেউ ব্যবসা বাণিজ্যে মগ্ন। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত এম এ লতিফ এমপি দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত। দলের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হয়ে দলীয় কাজের চেয়ে নিজের বলয় সৃষ্টি এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী। এছাড়া কারও কারও দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয়তায় নতুন কমিটি জরুরি হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় দলীয় প্রধান এবারের কমিটিতে দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ত্যাগী যোগ্য মেধাবী সৎ ও জনসম্পৃক্ত জনপ্রিয় নেতাদের সমন্বয়ে কমিটি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই দলীয় হাইকমান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে চট্টগ্রাম মহানগর নেতাদের সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করছেন। এবার চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ছোট তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, বর্তমান সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। সাংগঠনিক হাই প্রোফাইল থাকায় তাদের মধ্য থেকেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করার সম্ভাবনা বেশি। যদি তাই হয় সে ক্ষেত্রে বর্তমান সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় কোন পদে রাখা হতে পারে। বর্তমান চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকেও এবার বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বিবেচনায় যদি দলের মূল কোনো দায়িত্বে যদি রাখা না হয়, সে ক্ষেত্রে তাকে সহ-সভাপতি পদে রাখা হতে পারে।

সূত্রে আরও জানা যায়, সিনিয়র এই নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পদে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, বন ও পরিবেশ সম্পাদক মসিউর রহমান চৌধুরী এবং মহানগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর নামও রয়েছে।

কারও কারও বিশ্লেষণে, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন নানা কারণে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সার্বিক বিবেচনায় দলের স্বার্থে সভাপতির দায়িত্বে তাকে রেখেই নতুন কমিটি গঠন করা হতে পারে। চট্টগ্রাম মহানগরীর রাজনীতে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাই নওফেল ও আ জ ম নাছিরের মতামতের সমন্বয়ে গঠিত হবে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নওফেল ও আ জ ম নাছিরের সঙ্গে সম্প্রতি সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। আগামী কমিটিতে সে সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটবে বলেও অনেকে মনে করছেন।

তবে চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দলীয় প্রধানের একক এখতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলীয় প্রধান শুধুমাত্র চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি এবং শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পরামর্শ নিতে পারেন বলে সূত্রে জানা যায়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হবে বহু প্রতীক্ষিত ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। তার আগে সব থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটির কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্মেলনকে ঘিরে অন্যান্য কাজেরও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নতুন কমিটিতে নবীন প্রবীণের সমন্বয় এবং যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে বলে আমার বিশ্বাস।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অক্টোবরে সম্মেলনকে সফল করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সব নেতাকর্মীর মধ্যে বিরাজ করছে উৎসাহ উদ্দিপনা। নতুন কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের দায়িত্ব শুধু সম্মেলন সফল করা। কমিটি ঘোষণা করা হবে কেন্দ্র থেকে। সব কিছু নির্ধারণ করা হবে দলীয় প্রধানের মতামতের ভিত্তিতে। কাকে কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে তিনিই সবকিছু ভালো জানেন এবং বুঝেন। নিজের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ময়দানে আছেন। দায়িত্ববোধের কারণে দলের প্রতিটি কাজে নিয়মিত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সার্বিক বিবেচনায় নেত্রী এবং দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

নগর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে দলাদলির কারণে স্থানীয় নেতাদের একটি পক্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে নগরে নতুন কমিটি চায়। অন্য পক্ষ চাইছে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্র থেকে সরাসরি নতুন কমিটি দেওয়া হোক। নতুন কমিটি দেওয়া হলে তারাই তৃণমূলের সম্মেলন না হওয়া কমিটিগুলোর সম্মেলন করবে। তবে কেন্দ্রীয় নেতারাও চাইছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হোক। এরপর নগর কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচন কিভাবে হবে, তা কেন্দ্র ঠিক করবে। গুরুত্বপূর্ণ এই সাংগঠনিক ইউনিটে নেতৃত্ব নির্বাচন ভোটাভুটিতেও হতে পারে কিংবা কেন্দ্রও যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারে।

বর্তমান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য ইসহাক মিয়া, এ কে এম বেলায়েত হোসেন, ডা. ছৈয়দুর রহমান, মুহাম্মদ কলিমউল্লাহ চৌধুরী, সুলতান আহমেদ, নূরুল হক, আহমেদুর রহমান সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, খন্দকার সিরাজুল আলম, মোহাম্মদ সফর আলী, শেখ মাহমুদ ইসলাম এবং এম এনামুল হক।

সহ-সভাপতিরা হলেন, মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, নঈম উদ্দিন চৌধুরী, সুনীল কুমার সরকার, ডা. আফছারুল আমিন, নূরুল ইসলাম বিএসসি, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ এবং আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, উপদেষ্টা ও সহ-সভাপতিদের মধ্যে যারা বেঁচে নেই তাদের জায়গায় অন্য নেতারা স্থান পাবেন। বর্তমান সহ-সভাপতি যারা আছেন তাদের কয়েকজনকে উপদেষ্টা এবং বাকিরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদের আলোচনায় রয়েছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডে তেমন উপস্থিত না থাকলেও সাংসদ এম এ লতিফকে সদস্য পদ থেকে উপদেষ্টা অথবা সহ-সভাপতি পদে রাখা হতে পারে। এছাড়া সহ-সভাপতি রাখা হতে পারে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও জন্মাষ্টমী পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি সুকুমার চৌধুরীকে।

সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ, শফিক আদনান এবং চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক সাবেক কাউন্সিলর জালাল উদ্দিন ইকবাল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চন্দন ধর, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী, সদস্য বিজয় কৃঞ্চ চৌধুরী, কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন নানা সমীকরণের কারণে আলোচনায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বর্তমান পদে বহাল থাকবেন। আবার কারও কারও পদোন্নতিরও সম্ভাবনা রয়েছে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে