নান্তেরের রাস্তায় যেদিকেই তাকানো যায়, দেখা যাচ্ছে গত কয়েকদিনের দাঙ্গার চিহ্ন। প্যারিসের পশ্চিম দিকের এই শহরতলিটিতে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক পোড়ানো গাড়ি- সেগুলোর শুধু ধাতব খোলসটা আছে, ভেতরের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পথে পথে পড়ে আছে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লোহালক্কড়, গলে যাওয়া দরজার হাতল, ভাঙা কাচ।
এই এলাকাটিতেই নাহেলের বাড়ি- ১৭ বছরের যে কিশোর গত সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর এই দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এখানকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে- নাহেল হত্যার বিচার চেয়ে লাল-কালো রঙে লেখা স্স্নোগান। তরুণরা এভাবেই দেয়াল লিখন দিয়ে প্রকাশ করেছে তাদের ক্রোধ।
এখানকার কিছু বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির সংবাদদাতা মুরাদ শিশানি। এই বাসিন্দারা স্পষ্টতই পুলিশ বা সংবাদ-মাধ্যম কাউকেই বিশ্বাস করেন না। এক তরুণ চিৎকার করে সাংবাদিকদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বললেন। অন্য আরেকজন সাংবাদিকদের বললেন, 'আমরা যেন সাবধানে থাকি, কারণ আমাদের সঙ্গে থাকা ক্যামেরাগুলোর জন্য আমরাই আক্রান্ত হতে পারি।'
প্যারিসের বিত্তবান বাণিজ্যিক এলাকা লা ডিফেন্স প্রায় এখানকার লাগোয়া। কিন্তু নান্তেরেতে যারা থাকে, তাদের জন্য সেটা প্রায় অন্য এক জগৎ। নাহেলের হত্যাকান্ড ফরাসি সমাজে এক গভীর বিভক্তিকে প্রকাশ্য করে দিয়েছে। এখানকার বাতাসেই যেন সেই চাপা উত্তেজনা অনুভব করা যায়।
\হ'ওদের মতো আমরাও মানুষ'
একজন- বয়স তার বিশের কোঠায়- খানিকটা মন খুলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু তখনই আবার এগিয়ে এলেন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক আরেকজন লোক। মনে হলো, তিনি তরুণটিকে বলছেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলতে। কিন্তু তরুণটি কথা বলতেই থাকল। তবে এবার সে সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিল, যেন তার নাম উলেস্নখ করা না হয়। ফলে তার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে আবদুল নামে।
আবদুল ছিল নাহেলের প্রতিবেশীদের একজন। সে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। তার কথা, সে সহিংসতাকে কাজে লাগাতে চায়নি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য এটাই ছিল একমাত্র পন্থা। সে জানায়, 'ওরা আমাদের কথা শোনে না, আমাদের পাত্তা দেয় না। এখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোনো কাজ হয় না- তাই আমরা সহিংস পন্থার আশ্রয় নেই।' সে আরও জানায়, 'আমরা ওদের জানাতে চাই যে, আমরা ক্রুদ্ধ। আমরা ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই যে, যথেষ্ট হয়েছে... নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা থামাতে হবে, আরব ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ বন্ধ করতে হবে। এসব আর মেনে নেওয়া হবে না। ওদের মতো আমরাও মানুষ।'
বহিষ্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত
নাহেলের পরিবার যেখানকার বাসিন্দা, সে জায়গাটির নাম পাবলো পিকাসো এস্টেট। এখানে অনেকগুলো বহুতল ভবনে বাস করে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশই আরব ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। সে সময় ফ্রান্সে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকদের থাকতে দেওয়ার জন্য বাড়ি তৈরি করা দরকার হয়ে পড়েছিল।
বহুতল ভবনগুলোর একটিতে বাস করেন ফাতিহা আবদুনি। তিনি একজন সামাজিক অধিকারকর্মী। তিনি বলেন, 'আমরা কোনো বাড়িঘরে আগুন লাগাতে চাইনি বা কোনো কিছু ধ্বংস করতে চাইনি। কিন্তু আমরা এখন প্রচন্ড চাপ ও নিপীড়নের সম্মুখীন এবং আসলেই ক্রুদ্ধ।'
ফাতিহার বয়স ৫২ এবং তিনি ২০ বছরের বেশি আগে আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন। তার ছেলে ডিজলেক্সিয়া আক্রান্ত বলে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে বলে দিয়েছিলেন, 'ওকে দিয়ে কিছু হবে না'। এরপর থেকেই ফাতিহা সামাজিক অধিকারকর্মী হওয়ার ব্রত নেন। তিনি বলেন, 'নাহেলের মৃতু্য ছিল সেই স্ফূলিঙ্গের মতো- যা আমাদের ভেতরকার ক্রোধে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।' ফাতিহা বলেন, এই ক্রোধ তৈরি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে- যার কারণ তাদের বর্ণবাদী দৃষ্টিতে দেখা ও কাজের সুযোগের অভাব।
পাবলো পিকাসো এস্টেটের বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, এখানকার মানুষের মধ্যে কাজ করছে একঘরে হয়ে থাকা এবং ব্যাপকতর সমাজের দিকে থেকে আসা প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি। এ কারণে কিছু লোক অপরাধ ও মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। দেখা গেল, একজন মুখোশধারী ব্যক্তি একটি বহুতল ভবনে ঢোকার পথ পাহারা দিচ্ছে। অন্য আরেকজন মোটরবাইকে করে টহল দিচ্ছে, কখন পুলিশ আসে তার ওপর নজর রাখছে। এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনের একটি কেন্দ্র হলো স্থানীয় কফির দোকানগুলো। এগুলোতে বসে বাসিন্দারা খোলাখুলি আলোচনা করেন, এ দেশে অভিবাসীদের জীবন কেমন।
প্যারিসের উত্তর-পূর্বের উপশহরগুলোর একটি হচ্ছে ওবারভিলিয়ার্স। গত কয়েকদিনে এখানেও দাঙ্গা হয়েছে। এখানে একটি কফি শপে কথা হয় স্থানীয় দুজন বাসিন্দার সঙ্গে।
আব্দেলরাজাক ও ফাদি সম্প্রতি অবৈধ পথে ফ্রান্সে এসেছেন। তারা ফরাসি নাগরিক নন, তবে তাদের অভিযোগগুলো প্রায় একই রকম। আব্দেলরাজাক বলেন, 'এখানে আপনার অধিকার পদদলিত হচ্ছে, কারণ আপনি আরব। সবখানে বর্ণবাদ। ফরাসিরা আমাদের গ্রহণ করতে চায় না। আমরা জানি না কেন। আমরা তো এখানে শুধু কাজ করতে এসেছি।' তিনি বললেন, 'আমি পুলিশের খারাপ আচরণের শিকার হয়েছি। কখনো কখনো পুলিশ আমাদের কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে। আমাদের তারা আটক করে, অপমান করে, আমরা যখন তাদের সঙ্গে আলজেরীয় টানে ফরাসি বলতে চেষ্টা করি, তখন আমরা কী বলছি তা বোঝার চেষ্টাও তারা করে না।'
ফাদি বলেন, 'এমনকি যে আরবরা এখানেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং ফরাসি পাসপোর্টধারী, তারা দুই আত্মপরিচয়ের দোটানার মধ্যে আছে। তারা আরবও নয়, ফরাসিও নয়। তারা আছে মাঝখানে, তাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে গেছে।'
এসব অভিযোগ পুলিশের কাছে তোলা হলে তারা জবাব দেয়, 'ফ্রান্সের জাতীয় পুলিশ বাহিনী মূল্যবোধের মধ্যে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের স্থান নেই। তারা আমাদের সাবধান করল যে, এর বিপরীত যে দাবি করা হচ্ছে, তা বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সহায়ক হবে না।' পুলিশ বলছে, এই বাহিনীর ভেতরে কেউ এসব মূল্যবোধের বিরোধী কোনো কাজ করলে তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং 'বিপথগামীদের' কঠোর শাস্তি হয়।
মার্সেই শহর- যেখানে এবার দাঙ্গা গুরুতর আকার নিয়েছিল; সেখানকার অন্যতম কুখ্যাত এলাকা হচ্ছে ফ্রেইজ-ভালঁ। বিকালবেলা এখানে প্রকাশ্যেই মাদক বেচাকেনা চলতে দেখা যায়। এখানেই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির জেনি হিল। একজনের নাম আমিন- একজন সমাজকর্মী। তার বয়স যখন ১৭, তখন তার মাদক ব্যবসায়ী ভাই খুন হয়। আমিনের কথায়, এখানে মাদক চোরাচালান অনেক তরুণের জন্য লোভনীয় বিকল্প।
তার ভাষায়, 'কারণ এখানে আর কোনো বিকল্প নেই। কোনো কোম্পানি এখানে এসে বলবে না যে, তোমাকে আমরা নূ্যনতম মজুরির চেয়ে বেশি বেতন দেবো। এখানে লোকজন সুপারমার্কেট ক্যাশিয়ার, ক্লিনার আর সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিই করে। আমাদের বিচারপতি, আইনজীবী বা অ্যকাউন্ট্যান্ট হওয়ার কোনো উপায় নেই।' আমিন বলেন, এখানে তাদের অবস্থা একই রকম থাকবে- কিছুই বদলাবে না। তিনি বলেন, 'আমি তরুণদের ক্রোধ বুঝতে পারি। আমি সহিংসতা সমর্থন করছি না। কিন্তু আমি এর কারণ বুঝতে পারছি।'
এখানকার আরেক বাসিন্দা ম্যাডো- একজন মধ্যবয়সি মহিলা। তিনি বলেন, 'এখানে থাকাটা অনেকটা আবর্জনার বাক্সে বসবাস করার মতো। জায়গাটা নিরাপদ নয়। লোকে লিফট আর সিঁড়িতে মলত্যাগ করে। রাজনীতিবিদদের চোখে আমরা কিছুই নই। আসলেই কিচ্ছু নই।'
মুরাদ নামে আরেকজন বলছিলেন, 'এই জায়গাটার সবখানে ইঁদুরে ভর্তি। আমাদের সবার অধিকার সমান নয়। রাজনীতিবিদরা মিডিয়ায় বলে, আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নই। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো সত্যতা নেই।'
দাঙ্গার কয়েকদিন আগেই মার্সেই ঘুরে গেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। তিনি এই এলাকায় থানা, স্কুল, কারাগার ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন আমিন। তিনি বলেন, 'ম্যাখোঁ এখানে আসেন নানারকম ঘোষণা দিতে, আমাদের কথা শুনতে নয়।' সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ