শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
ইসরাইল-হিজবুলস্নাহ যুদ্ধবিরতি

মার্কিন প্রচেষ্টায় একটু বেশিই প্রত্যাশা

ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে গাজার যুদ্ধবিরতির পার্থক্য রয়েছে। ইসরাইল এবং লেবাননের চুক্তির ক্ষেত্রে জিম্মি বিষয়ক আলোচনা জড়িত নয়, যা গাজা চুক্তির বিষয়ে অচলাবস্থার অন্যতম একটা কারণ ছিল। তবে হিজবুলস্নাহ এবং ইসরাইলের যুদ্ধবিরতির ইসু্যতে প্রত্যেক পক্ষের উদ্দেশ্য এখনো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরাইল চায় উত্তরাঞ্চল থেকে ৬০ হাজার বাস্তুচু্যত মানুষকে ফিরিয়ে আনতে। আবার হিজবুলস্নাহ চাইছে, ইসরাইল লেবাননে হামলা বন্ধ করুক। সেখানেও দক্ষিণাঞ্চলে ৯০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মার্কিন প্রচেষ্টায় একটু বেশিই প্রত্যাশা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্য ১০ দেশ ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহর মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। এ প্রস্তাবের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের ঊর্ধ্বযতন কর্মকর্তারা এই ঘোষণাকে 'যুগান্তকারী' বলে বর্ণনা করেছেন।

এখন 'যুগান্তকারী' বলতে বাইডেনের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হলো- বর্তমানে ভয়াবহ যুদ্ধের আবহে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলোর কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সম্মতি পাওয়ার বিষয়কে তারা একটা বড় 'কূটনৈতিক সাফল্য' হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বিশ্বশক্তিগুলো যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, সেটি ঠিক সেই অর্থে যুদ্ধবিরতি নয়।

বিবৃতিতে ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহ দুই পক্ষকেই ২১ দিনের 'যুদ্ধবিরতির' মাধ্যমে লড়াই বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে মধ্যস্থতার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটা 'জায়গা তৈরি করা যায়'।

এরপর জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজু্যলেশন ১৭০১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটা কূটনৈতিক বন্দোবস্তের জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছে, যেমনটা ২০০৬ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে গৃহীত হয়েছিল। যদিও তা কখনোই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। গাজার 'থমকে' থাকা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে সমঝোতা নিয়েও এখানে বলা হয়েছে। তিন সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির বাইরে, আঞ্চলিক লক্ষ্য যা অধরা থেকে গেছে, তা পূরণের জন্যও প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু বিষয়ও আছে গত দুই দশক ধরে কূটনীতিকদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।

জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে নিউইয়র্কে জড়ো হয়েছিলেন বিশ্ব নেতারা। তাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সম্মতিক্রমে ইসরাইল-লেবানন সংকট নিয়ে বয়ান জারি করার সুযোগ পেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। যা একদিক থেকে 'সুবিধাজনক' হয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্ব শক্তিগুলোর যুদ্ধবিরতি আহ্বানের বিষয়ে সম্মতি অর্জন করার ক্ষেত্রে 'সাফল্যের' অর্থ এই নয় যে, ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহ এরই মধ্যে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ফেলেছে। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন মার্কিন কর্মকর্তারা (যুদ্ধবিরতি নিয়ে) দুই পক্ষের অবস্থান বাস্তবের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে রয়েছেন, এমনটা উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন। যেন 'পাবলিক মোমেন্টাম' (জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা) তৈরি করার এবং দুই পক্ষের (ইসরাইল ও লেবানন) ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন তারা।

কিন্তু ইসরাইল এবং লেবাননের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি? এর উত্তরে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, 'আমি এটুকু বলতে পারি, আমরা দুই পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনার ভিত্তিতে এ সময়টাকেই এই আহ্বান (যুদ্ধবিরতির বিষয়ে) জানানোর জন্য সঠিক সময় বলে মনে হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবের বিষয়ে তারা জানে। এ বিষয়ে কী করবে, সে নিয়ে বলার জন্য আমরা আগামী কয়েক ঘণ্টা তাদের দিচ্ছি।'

এখন প্রশ্ন হলো এর অর্থ কি ইসরাইল এবং হিজবুলস্নাহ এ বিষয়ে রাজি হয়েছে? এই প্রশ্নটা আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিজবুলস্নাহর সঙ্গে আমেরিকার সরাসরি কোনো রকম যোগাযোগ নেই। সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে ওই সিনিয়র কর্মকর্তা স্পষ্ট জানিয়েছেন, আমেরিকার পক্ষ থেকে ইসরাইল ও লেবানন সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে গভীর আলোচনা করা হয়েছে। যার অর্থ হলো, লেবাননের সরকারের তরফে নিশ্চয়ই হিজবুলস্নাহর কর্মকর্তাদের যোগাযোগ করা হয়ে থাকবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের আশা যখন লেবানন এবং ইসরাইল সরকার দুই পক্ষই এই প্রস্তাব মেনে নেবে, তখন দুইপক্ষের তরফেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।'

এ মুহূর্ত পর্যন্ত কথাগুলো বেশ 'আশাব্যঞ্জক' শোনাচ্ছিল। কিন্তু শুক্রবার গভীররাতের প্রেস ব্রিফিংয়ের পর কূটনীতিকরা বৈরুতসহ লেবাননে আরও কয়েকটা জায়গায় ইসরাইলি বিমান হামলার খবর পান। একই সঙ্গে ইসরাইলে হিজবুলস্নাহর কয়েকটা রকেট হামলারও খবর এসে পৌঁছায়।

গৃহযুদ্ধের পর লেবানন সবচেয়ে বেশি রক্তপাত দেখেছে চলতি সপ্তাহে। লেবাননের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তরফে জানানো হয়েছে, ইসরাইলি বিমান হামলায় ৭ শতাধিক মানুষের মৃতু্য হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ জন শিশুও আছে।

যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে?

শুক্রবার জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যাওয়ার জন্য নিউইয়র্কের উদ্দেশে বিমানযাত্রার আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় একটা প্রতিবাদী বিবৃতি জারি করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত কোনো কিছুতে রাজি হননি। শুধু তাই নয়, ওই বিবৃতিতে আরও উলেস্নখ করা হয়েছে যে, তিনি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীকে 'পূর্ণ শক্তি' দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষরের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, 'এটা সম্পূর্ণ অসত্য'।

ফলে বলা যেতে পারে, এই যৌথ বিবৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহর ওপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের পিছু হটতে এবং থামানোর জন্য একটা 'বেসলাইন অবস্থান' তৈরি করে। যুদ্ধবিরতির উদ্দেশে কাজ এখন চলবে। চলতি সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে নিউইয়র্কে এ বিষয়ে আরও কাজ করা হবে এবং তারপরও তা অব্যাহত থাকবে বলেই অনুমান করা যায়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই আলোচনায় ফরাসিদের পাশাপাশি নেতৃত্বে থাকা আমেরিকাও কিন্তু তাদের বয়ানে 'অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি' করার মতো শব্দ ব্যবহার করেছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর গাজায় জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এই জাতীয় যুদ্ধবিরতির আহ্বান সক্রান্ত প্রস্তাব কয়েক মাস ধরে 'সক্রিয়ভাবে আটকে' রেখেছিল আমেরিকা। এটা ততক্ষণ চলেছে, যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন 'অপ্রত্যাশিতভাবে' শব্দটি ব্যবহার করেন এবং মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। তারপর থেকে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে চলা নিবিড় কূটনীতি কিন্তু ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।

এজন্য অবশ্য আমেরিকা এখন হামাস ও ইসরাইলকে দায়ী করছে। তাদের যুক্তি, দুই পক্ষের 'রাজনৈতিক সদিচ্ছার' অভাব রয়েছে। এদিকে, আমেরিকা ইসরাইলকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টিও অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহকে চাপ দিয়ে দ্রম্নত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করাতে পারবে, এ বিষয়ে খুব একটা আস্থা তৈরি হয় না।

যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষত স্থলভাগে লড়াই, ইসরাইলের বিমান হামলার তীব্রতা এবং গত সপ্তাহে পেজার বিস্ফোরণের মাধ্যমে হিজবুলস্নাহর ওপর হামলা অব্যাহত থাকার মতো ঘটনাবলি দুই পক্ষের সংঘাতকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।

প্রসঙ্গত, ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে গাজার যুদ্ধবিরতির পার্থক্য রয়েছে। ইসরাইল এবং লেবাননের চুক্তির ক্ষেত্রে জিম্মি বিষয়ক আলোচনা জড়িত নয়, যা গাজা চুক্তির বিষয়ে অচলাবস্থার অন্যতম একটা কারণ ছিল। তবে হিজবুলস্নাহ এবং ইসরাইলের যুদ্ধবিরতির ইসু্যতে প্রত্যেক পক্ষের উদ্দেশ্য এখনো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরাইল চায় উত্তরাঞ্চল থেকে ৬০ হাজার বাস্তুচু্যত মানুষকে ফিরিয়ে আনতে। আবার হিজবুলস্নাহ চাইছে, ইসরাইল লেবাননে হামলা বন্ধ করুক। সেখানেও দক্ষিণাঞ্চলে ৯০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন।

এই শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ওই দেশে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। দক্ষিণে উপস্থিতি বজায় রাখাও তাদের লক্ষ্য। তারা চায় না, গত সপ্তাহের রক্তাক্ত ঘটনাগুলো লেবাননের ভঙ্গুর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মধ্যে তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভকে জাগিয়ে তুলুক।

ইসরাইল-লেবানন সংকট সমাধানের দায়িত্বে থাকা ওয়াশিংটনের দূত আমোস হোচস্টেইনের কাছে অবশ্য দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টা অধরাই থেকে গেছে। আর এখানেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই 'অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির' আকাঙ্ক্ষাটা 'জটিল' হয়ে উঠেছে। হোচস্টেইন বলেন, 'যৌথ বিবৃতিতে পৌঁছানোর আলোচনা সম্পর্কে আমার উপলব্ধি হলো, ওয়াশিংটন ২১ দিনের এই যুদ্ধবিরতিকে আসলে 'দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের' জন্য আলোচনার জায়গা প্রস্তুত করার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যকে নিশ্চিত করতে চাপও বাড়াচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, সমঝোতা আলোচনার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের রেজু্যলেশন ১৭০১ বাস্তবায়ন করতে গেলে ইসরাইল ও হিজবুলস্নাহর ওপর একাধিক শর্ত আরোপ হবে। এর মধ্যে রয়েছে লিতানি নদীর দক্ষিণে লেবাননের একটা খন্ড থেকে হিজবুলস্নাহর পশ্চাদপসরণ এবং দীর্ঘমেয়াদে ওই গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণ।

২০০৬ সাল থেকে দুই পক্ষই একে-অপরের বিরুদ্ধে ১৭০১ সালের এই রেজু্যলেশন ভঙ্গের অভিযোগ করে আসছে। এই পুরো বিষয়টার অর্থ হলো, প্রায় দুই দশক ধরে যে লক্ষ্য পূরণ করা কূটনীতিকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, তা এখন লেবানন-ইসরাইলে মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে একটা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন উভয়পক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কারণে দুই দিকেই রক্তপাত অব্যাহত, তখন এই 'বর্তমান কূটনীতি' বোধোহয় একটু বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলছে। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে